৯ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ১২:১২

নির্যাতনের লোমহর্ষক কাহিনী

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

জার্মানির ফ্যাসিবাদী শাসক এডলফ হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী কিংবা কমিউনিস্ট একনায়কতন্ত্রের কেজিবি ও তার সহযোগী বাহিনীগুলো সাধারণ মানুষ ও সন্দেহভাজনদের কিভাবে নির্যাতন করেছে, তার বিবরণ নানা স্থানে নানাভাবে লিপিবদ্ধ আছে। হিটলারের এই নির্যাতনকারী বাহিনী ছিল গেস্টাপো। তারা শুধু জার্মানিতেই ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর এই নির্যাতন চালিয়েছে তা-ই নয়, তারা যখন যে দেশ দখল করেছে, সেখানকার জাতীয়তাবাদীদের ওপরও একই ধরনের নির্যাতন চালিয়েছে। তা নিয়েও ডজন ডজন বই রচিত হয়েছে। স্মতিচারণ করেছেন বহু উচ্চপদস্থ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৩৯-১৯৪৫) কোনো কোনো নিরপেক্ষ দেশের শত্রু ছিল উভয়েই। এক দিকে হিটলারের জার্মানি, অপর দিকে কমিউনিস্ট রাশিয়া। অনেক দেশই চেয়েছিল, তারা তাদের গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে টিকে থাকবে। কিন্তু তা হতে দিতে চায়নি কোনো পক্ষই। হিটলার সেসব দেশকে দখলে নেয়ার চেষ্টায় ছিল। আর রাশিয়াও চাইছিল তাই। ফলে এই দেশগুলোর অবস্থা দাঁড়িয়েছিল চিঁড়াচ্যাপ্টা।

নরওয়েতে হিটলারের নির্যাতন সেলের একটি জাদুঘর রয়েছে। সেখানে জাতীয়তাবাদীদের ধরে এনে যে পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হতো, তার উপকরণগুলো এখনো সযতেœ সংরক্ষণ করা আছে। কক্ষগুলোও আছে তেমনি। স্কুলের শিশুদের জন্য সেখানে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রয়েছে। তা ছাড়া পর্যটক তো আসেনই হাজারে হাজার। সেখানে ইলেকট্রিক স্টোভের সঙ্গে চেপে ধরে বহু মানুষকে হত্যা করা হতো। ছিল সরতার মতো বড় যন্ত্র, যেগুলো দিয়ে কেটে ফেলা হতো হাতের কব্জি বা সব আঙুল। উপড়ে ফেলা হতো হাত-পায়ের নখ। হ্যান্ডকাফ বেঁধে ছাদে ঝুলিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হতো জাতীয়তাবাদীদের। অত্যধিক মদ বা মাদক সেবন করিয়ে পিটিয়ে লাথি মেরে মেরে, নারী-পুরুষদের হত্যা করা হতো। চেয়ারে বসিয়ে শিকল দিয়ে বেঁধে সারা শরীরে বেত্রাঘাত করা হতো। ছোট্ট নির্জন কক্ষে মাসের পর মাস বসিয়ে রাখা হতো। পর্যাপ্ত খাবার কখনো দেয়া হতো না। নারী নির্যাতন ছিল নিয়মিত ঘটনা। আবার বন্দিশিবিরে রাশিয়ার সৈন্যরা কাগজ বা কাঠের টুকরো দিয়ে খেলনা বানিয়ে স্থানীয় লোকদের দিয়ে কিছু খাদ্য সংগ্রহ করত।

এর বিপরীত চিত্রও ছিল। রাশিয়া পোল্যান্ড দখল করে এমনই বন্দিশিবির গড়ে তুলেছিল। সেখানে পোলিশ জাতীয়তাবাদীদের ওপর চলে বীভৎস নির্যাতন। পোলিশ হোম আর্মির প্রচারণা প্রধান কাজিমিয়ার্জ দামাজি মোকজারস্কিকে গ্রেফতার করা হয় ১৯৪৬ সালে, নাৎসি বাহিনীকে সহযোগিতার অভিযোগে। তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। পরে তা অবশ্য পাঁচ বছর মওকুফ করা হয়। কারাগারে থাকার সময় মোকজারস্কির ওপর যে নির্যাতন করা হয়েছে, তিনি তার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ৪৯ রকম পন্থায় তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তার মধ্যে ছিল নিয়মিত চড়-থাপ্পড় মারাসহ নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। ধাতব লাঠি দিয়ে প্রহার। কাঠ বা অন্য কোনো শক্ত জিনিস দিয়ে মারধর। কাঠের লাঠিতে ধাতব পাত পেঁচিয়ে সেটা দিয়ে পেটানো। বেত ও চাবুক মারা। পিটিয়ে নাক ও কাঁধের হাড় ভেঙে দেয়া। গলা টিপে ধরে শ্বাস রোধ করা। পায়ের পাতা ও গোড়ালিতে ধাতব ও রাবারের বেত দিয়ে আঘাত। মাথার খুলিতেও ধারাবাহিকভাবে আঘাত করা হতো।

মোকজারস্কি আরো জানান, নির্যাতনকারীরা তার চোখ ও ঠোঁটে বারবার জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দিত। তারা তার দুই হাতের প্রতিটি আঙুল পুড়িয়ে দিয়েছিল। ছেঁচে দিয়েছিল দুই হাতের আঙুল ও পায়ের গোড়ালি। সারা শরীরে লাথি মারা ছিল নিয়মিত ব্যাপার। তারা তার অণ্ডকোষ ও নিতম্বেও লাথি মারত। পিন ও কলমের নিব দিয়ে সারা গা, মুখ ও কানে খোঁচা দিত। মলের ওপর বসে থাকতে বাধ্য করা হতো। গরম পানিতে বসিয়ে মলদ্বারে ফোসকা ফেলে দিত। গোঁফ, চুল ও বুকের লোম টেনে উপড়ে ফেলে দিত। বাড়ির সঙ্গে তাকে যোগাযোগ করতে দেয়া হতো না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও কোনো খাবার দেয়া হতো না। মধ্যরাতে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে তাকে নগ্ন করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অহেতুক সারা শরীর তল্লাশি করা হতো। তার বিছানায় ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দেয়া হতো। প্রস্রাবের সাথে রক্ত যেতে শুরু করেছিল, তবু তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়নি। অকথ্য ভাষায় তাকে ও তার পরিবারকে গালিগালাজ করা হতো। দুই বছর ১০ মাসের মধ্যে তাকে এক দিনও গোসল করতে দেয়া হয়নি। ছয় বছর তিন মাস তাকে যেতে দেয়া হয়নি খোলা আকাশের নিচে। কখনো বলা হতো তার স্ত্রী যক্ষ্মায় মারা গেছে। কখনো বলা হতো, তার স্ত্রী অমুকের সাথে নিয়মিত দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করছে। কখনো কখনো তার কপালে রঙপেনসিল দিয়ে লিখে দেয়া হতো ‘নাজি’ এবং সেটা তারা মুছতে দিত না।

আরো বহু দেশের শাসকদের দ্বারা নাগরিকদের ওপর এ ধরনের নির্যাতনের প্রচলিত আছে। নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত হিটলারের গেস্টাপো, সোভিয়েত ইউনিয়নের কেজিবি, ইরানের শাহর সাভাক, ইসরাইলের মোসাদ। নিষ্ঠুর নির্যাতনে এরা বহু রকমে পারদর্শী। এ দিকে, বাংলাদেশের র‌্যাব বোধ করি নতুন বিতর্কে জড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি সুইডেনের সরকার পরিচালিত ‘সভারিজেস রেডিও’ গোপনে ধারণকৃত এক র‌্যাব কর্মকর্তার কথোপকথনের অডিও প্রকাশ করেছে। অডিওটি ছিল দুই ঘণ্টার। রেডিও তার নয় মিনিট বাংলা ভার্সনও সরাসরি প্রচার করে। এতে বাংলাদেশ পুলিশের এলিট বাহিনী, রাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) কিভাবে মানুষ হত্যা এবং অপহরণ করে তার বর্ণনা উঠে এসেছে। ওই অডিওতে একজন উচ্চপদস্থ র‌্যাব কর্মকর্তা বাহিনীটির অপহরণ, হত্যা ও লাশ গুমের বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দেন। এই বর্ণনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা না করে সন্তোষজনক উপসংহারই জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/210611