৯ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ১২:১১

আত্মপক্ষ

বহুজাতিক নদীর পানি বণ্টন

এবনে গোলাম সামাদ

যে নদী একাধিক রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, তাকে ধরা হয় বহুজাতিক নদী। বহুজাতিক নদীর পানিবণ্টন নিয়ে বেশ কিছু কনভেনশন বা প্রথা গড়ে উঠেছে। ইউরোপে দানিয়ুব নদীর পানি নিয়ে অনেক ঝগড়া-ফাসাদ হয়েছে। প্রধানত তা মেটাতে গিয়ে উদ্ভব হতে পেরেছে নদীর পানিবণ্টন নিয়ে এসব প্রথার। এসব প্রথার মধ্যে একটি হলো কোনো নদী যেসব দেশের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, নদীটিতে ওইসব দেশের অধিকার মেনে নেয়া।

নদীর পানি দেশগুলোতে ভাগ করার সময় বিবেচনায় নিতে হবে সারা বছর ওই নদী দিয়ে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয়, তার কথা। ধরা হয়, ওই নদীর ওপর একটা দেশের কত মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভর করছে সে কথাও। জীবিকার ক্ষেত্রে মাছ ধরার কথার বিবেচনায় নেয়া হয়। বিবেচনায় নেয়া হয়, নদীপথে গমনাগমনের বিষয়টিকেও। অর্থাৎ নদীর নব্যতাকেও।

যেসব নদী ভারতের মধ্য দিয়ে বয়ে বাংলাদেশে এসেছে, তাদের পানি ভাগের সময় এসব প্রথাকে যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না বলেই সমস্যা হতে পারছে জটিল। যেমনÑ গঙ্গায় প্রতি বছর কত পানি প্রবাহিত হয় সেটার হিসাব না করে ধরা হচ্ছে, গঙ্গার পানি পশ্চিমবঙ্গে কী পরিমাণ আসছে। এই পানিকে গঙ্গার মোট পানি ধরে ভাগ করার চেষ্টা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের মধ্যে। অথচ ধরা উচিত গঙ্গা নদী দিয়ে বছরে কী পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয়, তার কথা। কেননা, বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র। ভারত আর একটি রাষ্ট্র। পানি ভাগ হতে হবে এ দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যে নয়। একইভাবে তিস্তা নদীর পানি ভাগ হতে হবে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যে নয়। এ ক্ষেত্রেও বিচার্য হতে হবে, তিস্তা নদী দিয়ে বছরে কী পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয়, তার হিসাব।

তিস্তা নদীর উদ্ভব হয়েছে সিকিমে। তার পরে তা পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসেছে বাংলাদেশে। এবং বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তা পড়েছে যমুনায়। তিস্তা অবশ্য চিরদিন যমুনায় গিয়ে পড়ত না। একসময় তা প্রবাহিত হয়ে এসে পড়ত পদ্মায়। ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তিস্তা গতি পরিবর্তন করে পড়তে থাকে যমুনায়। তিস্তা নদী হঠাৎ করেই উৎপন্ন হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, তিস্তায় পানি নেই। কিন্তু হঠাৎ করেই তিস্তার পানি উধাও হয়ে যেতে পারে না। পানি উধাও হয়ে যাওয়ার কোনো ভৌগোলিক কারণ তিনি দেখাতে পারছেন না। সিকিম যদি পশ্চিমবঙ্গকে কম পানি দেয়, তবে পাশ্চিমবঙ্গকে বোঝাপড়া করতে হবে সিকিমের সাথে। বাংলাদেশকে তা বলে তিস্তার পানি থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। তিস্তা বয়ে চলেছে সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে। তিস্তা বাংলাদেশেরও নদী। তিস্তার পানির ওপর আছে বাংলাদেশের অধিকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে অধিকার হরণ করেতে পারে না। সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন না, তিস্তার পানিতে বাংলাদেশের অধিকার নেই; এ ধরনের কোনো কথা। তা ছাড়া বাংলাদেশের চুক্তি হবে ভারত সরকারের সাথে, পশ্চিমবঙ্গের প্রাদেশিক সরকারের সাথে নয়। সিকিম সরকারের সাথেও নয়। এ ক্ষেত্রে সিকিমের প্রধানমন্ত্রীকে ডাকা হচ্ছে না, ডাকা হচ্ছে কেবল পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে। বিষয়টি আমাদের কাছে তাই মনে হচ্ছে যথেষ্ট গোলমেলে। আমরা শঙ্কিত হচ্ছি। কেননা আমার ঝগড়া করতে চাই না পশ্চিম বাংলার সাথে। আমার পানির ভাগ চাই আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুসারে। চুক্তি হতে হবে ভারত সরকার এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে।

ভারতের সংবিধান বলে (৩৬৭ নং ধারার ৩ নং অনুচ্ছেদ) ভারত ছাড়া যেকোনো রাষ্ট্রই বিদেশী রাষ্ট্র, তবে ভারতের রাষ্ট্রপতি কোনো রাষ্ট্রকে বিদেশী রাষ্ট্র নয় বলেও ঘোষণা করতে পারেন। ভারত সরকার কি এ রকম কিছু করার কথা চিন্তাভাবনা করছে? যদি করে তবে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ হারাবে তার অস্তিত্ব। কেননা থাকবে না তার সার্বভৌমত্ব। ভারতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বয়ে আসছে ৫৪টি নদীর পানি। এর মধ্যে একমাত্র গঙ্গা ছাড়া এখন পর্যন্ত ভারতের সাথে আর কোনো নদীর পানির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে হতে পেরেছিল হাসিনা-দেবগৌড় চুক্তি। কিন্তু সেই চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ পদ্মায় পানি পাচ্ছে না। ভারতের সাথে চুক্তি করলে সেই চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়েও থাকছে নানা সন্দেহ। যত কারণে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক মসৃণ হতে পারছে না, তার একটি বড় কারণ হলো অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন। এই সমস্যার সমাধান করতে না পারলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের মৈত্রী আন্তরিকতা পেতে পারবে না। উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে আস্থার ঘাটতি বেড়ে যেতেই থাকবে (Pia Malhotra. Water Issues between Nepal, India and Bangladesh. Institute of Peace and Conflict Studies. New Delhi. July 2010)। ভারত ঠিক কী চাচ্ছে তা আমরা জানি না। বিলাতের The Guardian পত্রিকায় Vidhi Doshi (18 may 2016) একটি সংবাদে বলেন, ভারত সরকার ভারতের ৩০টি নদীর মধ্যে সংযোগ-খাল খনন করতে চাচ্ছে এক নদী থেকে পানি আরেক নদীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এর আগে আমরা শুনেছিলাম, গঙ্গা থেকে পানি নিয়ে যাওয়া হবে দক্ষিণ ভারতের কাবেরি নদীতে। এ রকম যদি করা হয়, তবে গঙ্গা দিয়ে পানি আগের মতো আর আসবে না পশ্চিমবঙ্গে। আর তাই থাকবে না পদ্মা নদীতেও পানি। কেননা, পশ্চিমবঙ্গ যদি গঙ্গার পানি না পায় তবে ফারাক্কা পেরিয়ে পানি আসবে না পদ্মায়। পদ্মা পরিণত হবে একটা মৃত নদীতে। হাসিনা-দেবগৌড় চুক্তি অনুসারে ফারাক্কায় যে পানি আসবে, সেই পানি কেবল ভাগ হতে পারবে পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশের মধ্যে। গঙ্গার সমগ্র প্রবাহকেও নেয়া হচ্ছে না বিবেচনার মধ্যে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ গঙ্গার পানি কতটা পেতে পারবে তা নিয়েও সৃষ্টি হতে পারছে সংশয়।

ভারতের সাথে সিন্ধু নদীর পানি নিয়ে পাকিস্তানের বিবাদ বেধেছিল। বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় যার সমাধান হতে পেরেছিল ১৯৬০ সেপ্টেম্বর মাসে (Indus Water treaty)। কিন্তু ভারত আবার নতুন করে সিন্ধু নদীর পানি নিয়ে পাকিস্তানের সাথে বিবাদ শুরু করেছে। এর ফলে যুদ্ধ বাধতে পারে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে। মনে হচ্ছে ভারত এ কারণেই চাচ্ছে বাংলাদেশের সাথে বিশেষ প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে। প্রতিরক্ষা চুক্তি একটা গুরুতর ব্যাপার। দেশের পার্লামেন্টে পর্যালোচনা না করে এ রকম কোনো চুক্তি করা হবে বিষম ভুল। কী ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তি হতে যাচ্ছে, দেশবাসীর তা জানার অধিকার আছে। পাকিস্তানের সাথে আমাদের বর্তমানে আর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তাই বলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে আমরা ভারতের পক্ষ নিতে পারি না। পাকিস্তান আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র না হলেও নিশ্চয় শত্রু রাষ্ট্র নয়। এ ছাড়া ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধলে আরো একাধিক রাষ্ট্র এ যুদ্ধে যে জড়িয়ে পড়বে, সে সম্বন্ধে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। পাকিস্তান একা ভারতের সাথে লড়াই করবে না। কেননা, পাকিস্তানের গোয়াদারে চীন গড়ে তুলেছে বিরাট নৌঘাঁটি। এ ছাড়া কাশ্মিরের আকসাই চীন ও লাদাখ অঞ্চল রয়েছে চীনের নিয়ন্ত্রণে। সে এই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেই চাইবে। চীন চেয়েছিল নেপাল, সিকিম ও ভুটানকে নিয়ে হিমালয়েন ফেডারেশন গড়তে। ভারত তাই সিকিম অধিকার করে। চীন আবার তার পুরনো পরিকল্পনায় ফিরে যেতে চাইতেও পারে।

হিমালয় সীমান্তে ঠিক কী হচ্ছে, আমরা তা জানি না। ভারতের অরুণাচল প্রদেশের বিরাট একটা অংশকে চীন দাবি করছে নিজের অংশ বলে। ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি করার আগে এসব বিষয়ে আমাদের গভীরভাবে ভাবা প্রয়োজন।

সর্বোপরি উত্তর ও পশ্চিম ভারতে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ আবার প্রবল হয়ে উঠছে। গুজরাটে কেউ গরুর গোশত ভক্ষণ করতে পারবে না। করলে তার প্রাণদণ্ড হবে, এই আইন পাস করা হলো। আর বাংলাদেশে বলা হচ্ছে ভারতের বন্ধুত্ব অর্জনের কথা। এটা বাস্তবে কতটা সম্ভব হবে, সেটা ভাবারই বিষয়। দিল্লির একটা পথের নাম করা হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। কিন্তু নাম দিয়ে বন্ধুত্বের ভিত্তি রচিত হতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন মনমানসিকতার পরিবর্তন।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/210612