ভারতের সিকিম থেকে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত তিস্তা নদীর ওপর এমন অসংখ্য বাঁধ-প্রকল্পে পানি-প্রবাহ আটকা পড়ছে -ছবি : ওয়েবসাইট
৮ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ৮:৩৬

ভারতের দুই রাজ্যে ১৪ বাঁধে আটকা পড়েছে তিস্তার পানি

* গজলডোবা বাঁধ না ভাঙলে চুক্তি দিয়ে কোনো লাভ হবে না

* অভিন্ন নদীর মোট পানিপ্রবাহ হিসেবে এনে প্রাপ্য পানি দাবি করা যেতে পারে

ভারতের সিকিম থেকে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা পর্যন্ত অন্তত ১৪টি বাঁধে আটকা পড়ে থাকে তিস্তার পানিপ্রবাহ। ফলে গজলডোবার ভাটিতে যথেষ্ট পানি জমা হতে পারে না। এরকম অবস্থায় যেনতেন প্রকারে একটা ‘তিস্তা চুক্তি’ হলেও তা কোন কাজেই দেবে না বাংলাদেশের। ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ‘তিস্তায় তো পানিই নেই।’

তিস্তা নদী হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে সিকিম এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে বাংলাদেশের যমুনা নদীতে এসে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার উপর শুধু সিকিমেই তৈরি হয়েছে ৫টি বৃহদাকার ড্যাম। এগুলো হলো, চুংথান্ড ড্যাম, টিনটেক ড্যাম, সেরওয়ানি ড্যাম, রিয়াং ড্যাম ও কালিঝোরা ড্যাম। এছাড়াও বর্তমানে চলমান প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, লোয়ার লাগিয়াপ, রামমাম-২, রণজিৎ-৩, তিস্তা-৫ এবং রঙ্গিচু। এগুলো সবই পানি-বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এগুলোর জন্য অবশ্যই তিস্তার পানি সরানো ও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন হবে। সিকিমে আরও ৪টি এধরনের প্রকল্পের প্রস্তাব সরকারের হাতে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে গজলডোবা ব্যারেজ ও তিস্তা-মহানন্দা সংযোগ খাল। তিস্তার একটি প্রকল্প ম্যাপ থেকে এমন ১৪টি স্থানে প্রকল্প চিহ্নিত দেখতে পাওয়া যায়। এসব প্রকল্পের কারণে উজান থেকে সিকিম হয়ে যথেষ্ট পরিমাণ পানি যেমন পশ্চিমবঙ্গে এসে পৌঁছায় না, তেমনি পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রবাহও গজলডোবায় আটকে যায়। আর তিস্তার পানি মহানন্দার ক্যানেল দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ কৃষি জমিতে সেচ দেয়া হয়। ফলে বাংলাদেশ কি পরিমাণ পানির ভাগের জন্য অপেক্ষা করছে তা পরিষ্কার নয়। কারণ, এখন কেবলই গজলডোবা বাঁধ থেকে নামা সামান্য পানি এবং বৃষ্টির অনিশ্চিত পরিমাণ পানির উপরেই বাংলাদেশকে ভরসা করতে হয়। এই অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গজলডোবা পয়েন্টের হিসেব আমলে নিয়ে বাংলাদেশকে সত্যি সত্যি পানির নায্য হিস্যা দিতে হলে এই ব্যারেজটিই ভেঙে ফেলতে হবে। তবেই পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি আশা করা যায়। আর পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রাপ্তির বিষয়টি তারা সিকিমের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে পারে। উজানে তিস্তার যে দীর্ঘ গতিপথ ভারতের সিকিমের ভেতরে এবং সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের সীমানায় প্রবাহিত হচ্ছে, সেখান থেকে ভারত যে পানি প্রত্যাহার করছে বা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র করছে, চুক্তি হলে তাতেও ঝামেলা বাড়তে পারে আশঙ্কা রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে তিস্তা চুক্তির আওতায় আদৌ বাংলাদেশ এ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা কখনো পাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান হওয়ার যথেষ্ট কারণ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ১৯৮৬ সালে জয়েন্ট কমিটি অব এক্সপার্টের সভায় বাংলাদেশ নদীর পানি ভাগাভাগির একটি সার্বিক রূপরেখা প্রদান করে। এতে বাংলাদেশ ব্রহ্মপুত্র নদের ৭৫ শতাংশ এবং তিস্তাসহ আটটি নদীর পানির ৫০ শতাংশ পানি দাবি করে। পরে বাংলাদেশ নির্দিষ্টভাবে ২০ শতাংশ পানি তিস্তার নাব্যতার জন্য রেখে দিয়ে বাকি ৮০ শতাংশ সমান ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়। ভারত এটি মেনে নেয়নি। ভারতের কোন কোন মহল থেকে এ সময় ভারতের অধিক পরিমাণ কৃষিভূমি ইতোমধ্যে সেচ সুবিধা ব্যবহার করছে- এই যুক্তিতে তিস্তার সিংহভাগ পানি দাবি করে। ফলে বিষয়টি আজো সেই অনিশ্চয়তার দোলাচলে দুলছে।

প্রাপ্ত তথ্যে আরো দেখা যায়, এছাড়াও তিস্তাকেন্দ্রিক বেশ কয়েকটি ক্যানেল প্রকল্প করা হয়েছে, যেগুলো দিয়ে নিয়মিত পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে তিস্তা-মহানন্দা লিংক ক্যানেলের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ কিলোমিটার। এই ক্যানেলের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৭৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরণ খালের সংখ্যা ১০টি। মহানন্দা প্রধান ক্যানেলের দৈর্ঘ্য ৩২ কিলোমিটারের বেশী। এই ক্যানেলের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৭১ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরণ খালের সংখ্যা ১৩টি। ডাউক নগর প্রধান ক্যানেলের দৈর্ঘ্য ৮০ কিলোমিটারের বেশী। এই ক্যানেলের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৯৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরণ খালের সংখ্যা ১৮টি। নাগর টাঙ্গন প্রধান খালের দৈর্ঘ্য ৪২ কিলোমিটারের বেশি। এর মাধ্যমে বছরে ১ লাখ ১৬ হাজার হেক্টরের বেশী জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরণ খালের সংখ্যা ৮টি। তিস্তা-জলঢাকা প্রধান ক্যানেলের দৈর্ঘ্য ৩০ কিলোমিটারের বেশি। এর মাধ্যমে ৫৮ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরণ খালের সংখ্যা ৬টি।

তিস্তার পানি ব্যাপকভাবে সরিয়ে নেয়ার পর এই অবস্থায় বাংলাদেশ কী পরিমাণ পানি পেতে পারে তা সহজেই অনুমেয় উল্লেখ করে নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, একদিকে সিকিমে ব্যাপকভাবে পানি প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে অবশিষ্ট পানি প্রত্যাহার করে সেচের কাজে লাগানো হচ্ছে। এখন কেবল অনিশ্চিত পরিমাণ বৃষ্টির পানিই ভরসা। যা কোন প্রকার বণ্টন প্রক্রিয়ার আওতায় আসার কোন মানে নেই। ফলে এনিয়ে কোন দেনদরবার হবে একটা বাহুল্য প্রক্রিয়ামাত্র। এই সঙ্গে মাহবুব সিদ্দিকী মনে করেন, সামগ্রিকভাবে অভিন্ন নদীর পানিপ্রবাহ একটা ‘প্যাকেজ ডিল’-এর আওতায় নিয়ে বাংলাদেশের প্রাপ্য দাবি করা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ভারতের বিজেপি সরকারের সঙ্গে তিস্তার পানি ব্যবহার নিয়ে কোনো ‘লোক দেখানো চুক্তি’ চায় না। তারা চায়, ভারত ও বাংলাদেশ তিস্তার পানি চুক্তি সম্পাদনকালে জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের নদী কনভেনশনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে।

http://www.dailysangram.com/post/278948-