৬ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:০৭

বিরোধী জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারের ইঁদুর-বিড়াল খেলা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন

স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারের অবিরাম ‘ইঁদুর-বিড়াল খেলা’ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট আইন বাতিল ও অকার্যকরের যে আদেশ উচ্চ আদালত দিয়েছেন তা প্রতিপালন ও কার্যকরের কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
স্থানীয় সরকারের ২০০৯ সালের সেই আইনটি ইতোমধ্যে সর্বোচ্চ আদালত বাতিল করে দিয়েছে। হাইকোর্টের সেই আদেশে বলা হয়, ২০০৯ সালের স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইনের ১২(১) ধারার বলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সাময়িক বরখাস্ত সংক্রান্ত যে বিতর্কিত অর্ডার ইস্যু করে তা আইনগত কর্তৃত্ব ছাড়াই করা হয়। ফলে এর কোন আইনগত কার্যকারিতা নেই। হাইকোর্টের এই আদেশে সরকারকে এ সংক্রান্ত বিধি-বিধান সংশোধন করার জন্য বলা হয়। এছাড়া নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের বরখাস্ত করার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য বিধি তৈরির জন্যও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। সুপ্রিম কোর্টে আপিল বিভাগ এই আদেশ বহাল রাখায় তা নিয়ে আর কোন বিতর্কেরও অবকাশ নেই। কিন্তু এর পরেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সেই আইন প্রয়োগ করে জনপ্রতিনিধিদের সাসপেন্ড করে চলেছে। গত কয়েকদিনে এরকম বেশ কয়েকজন মেয়রকে দ্বিতীয় দফায় সাসপেন্ড করা হয়। কিন্তু ইতোমধ্যে অন্তত তিনজন রাজশাহী, সিলেট ও হবিগঞ্জের মেয়র এই দ্বিতীয় দফার বহিষ্কার আদেশকে স্থগিত করাতে সক্ষম হয়েছেন। গত দু’দিনে আরও বরখাস্ত হয়েছেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী পৌরসভার মেয়র, মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ফরিদপুরের সালথা উপজেলা চেয়ারম্যান। এর আগে ২৩ মার্চ গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান এবং কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এদের কেউই সরকার সমর্থক নন বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত সাড়ে ৩ বছরে চার সিটি কর্পোরেশনের মেয়রগণ, ৩৫ পৌর মেয়র, ৫৬ কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান ৪৯ জন, ভাইস চেয়ারম্যান ৬৬ জন, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ৯১ ও মেম্বার ৭৪ সহ ৩৭৫ জন বরখাস্ত হয়েছেন। এদের অধিকাংশই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। নানাবিধ ফৌজদারী মামলায় আসামী করে এবং পুলিশের তৈরি চার্জসিট-এর উল্লেখ করে এই বরখাস্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। এরা স্ব স্ব পদে বসতে না পারায় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণ। ব্যাহত হচ্ছে স্থানীয় সরকারের উদ্দেশ্যও। অন্যদিকে, প্রায়শই বরখাস্তকৃত জনপ্রতিনিধিরা উচ্চ আদালতের আদেশ নিয়ে পুনরায় চেয়ারে বসে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখছেন। কেউ কেউ দ্বিতীয়বারের মতো উচ্চ আদালতের আদেশ সংগ্রহ করছেন। এর ফলে দেখা যাচ্ছে, সরকারের এই কর্মকাণ্ডের প্রতি আইন-অঙ্গনেরও সমর্থন নিরঙ্কুশ নয়। বরং এক নেতিবাচক মনোভাবই বিরাজ করছে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ দেবার পর নতুন মামলা দিয়ে চেয়ার থেকে দূরে রাখার প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে।
সরকার সবকিছু ‘আইন অনুযায়ী’ হচ্ছে বলে দাবি করে আসলেও এই আইনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করে আসছেন। এক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হলেও বিরোধীদলীয় হবার কারণে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রণালয়টি তাদের সঙ্গে ‘ইঁদুর-বিড়াল খেলা’ করে চলেছেন। বিষয়টি সারা দেশে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও সরকারি মহলের তাতে তোয়াক্কা নেই বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। রাজনৈতিক ও আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার সংশ্লিষ্ট আইনটি নিজেদের স্বার্থে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য ব্যবহার করছে। তারা এটিকে কালো আইন হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছেন। তাদের মতে, চূড়ান্ত রায়ের আগেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিকে এ আইনের সুযোগ নিয়ে বরখাস্ত করা হচ্ছে। যদিও সর্বোচ্চ আদালতে এই আইন বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু আদালতের এই রায় প্রতিপালন ও কার্যকর কেন হচ্ছে না- তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ইতোমধ্যে এক মাস পার হয়ে গেলেও এনিয়ে কোন কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
সূত্র জানায়, এ বছরই রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, গাজীপুর ও রংপুর সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন হবে। এর মধ্যে রংপুর বাদে বাকি সব সিটিতে মেয়র বিএনপি’র। বরখাস্ত-কারাবরণের কারণে তারা দায়িত্ব পালন থেকে বঞ্চিত থেকেছেন। সরকারি মহলের চিন্তা, এ মেয়রদের ‘জনবিচ্ছিন্ন’ দেখিয়ে আগামী নির্বাচনে তারা একচেটিয়া সুযোগ নিতে পারবে। এসব সিটির মেয়রের চেয়ার দখলের সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে আওয়ামী লীগ। এ জন্য সরকার নতুন করে বিএনপি’র মেয়রদের অবস্থান শক্ত করার সুযোগ দেয়ার পক্ষে নয়। তবে কুমিল্লা সিটিতে বিএনপি’র ‘যুদ্ধজয়’ সরকারের জন্য সুখকর দৃষ্টান্ত নয় বলেও বিশ্লেষকরা মনে করেন।
এ ব্যাপারে একজন আইনজীবী জানান, যে আইন সর্বোচ্চ আদালতে প্রশ্নবিদ্ধ হলো তা ব্যবহার করে পুনরায় বরখাস্ত করা সঠিক হয়নি। যে কারণে সর্বশেষ রিটগুলোতে আদালত দ্রুত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আর সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উচিত, দ্রুত উচ্চ আদালতের আদেশ প্রতিপালনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

http://www.dailysangram.com/post/278693-