গতকাল বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে সাউথ এশিয়া ইয়ুথ ফর পিস এন্ড প্রসপারিটি সোসাইটির উদ্যোগে বাংলাদেশ-ভারত পানি বিতর্ক বিষয়ে আয়োজিত সেমিনারে বক্তব্য পেশ করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন -সংগ্রাম
৬ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:০৫

ভারতের সব চাহিদা পূরণ করলেও বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি

বর্তমান সরকার জনগণের সরকার নয় দাবি করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী মেজর (অব,) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে না। বর্তমান সরকার ভারতের যা যা চাহিদা ছিল তার সবই দিয়েছে দাবি করে বিএনপির এই নেতা বলেন, এর বিনিময়ে বাংলাদেশ ঐ দেশটি থেকে কিছুই পায়নি। গতকাল বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাউথ এশিয়া ইয়ুথ ফর পিস অ্যান্ড প্রোসপারিটি সোসাইটি আয়োজিত ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ওয়াটার ডিসপিউট’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। উল্লে¬খ্য আগামীকাল শুক্রবার চার দিনের সফরে ভারত যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সফরের আগে আগে বিএনপি আটকে থাকা তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ও এই সফরে কথিত নিরাপত্তা চুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে সমালোচনায় সোচ্চার।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বেগম সেলিমা রহমান, গণস্বাস্থের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফজুল¬াহ চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, সাংবাদিক ওবায়দুর রাহমান, বিএনপির সহ তথ্য সম্পাদক কাদের গণি চৌধুরী, ফরিদুর রহমান প্রমুখ এই সেমিনারে বক্তব্য রাখেন। বিশিষ্ট পরিবেশবাদী নুর মোহাম্মদের সভাপতিত্বে সেমিনারের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক এস আলম।
সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের সমস্যাই পানি। তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আমাদের পানি দেবে না। ‘তিস্তা চুক্তির মতো একটি বিষয় না হলে কিছু যায় আসে না।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এইচ এম মাহমুদ আলীর এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে হাফিজ উদ্দিন বলেন, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তিস্তা চুক্তি না হলে কিছু আসে যায় না। আসলে এ্ই সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। তাই তাদের জনগণের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা নাই। আর এ কারনে সরকারের মন্ত্রী এইভাবে কথা বলেন।
মেজর হাফিজ বলেন ১৯৯৬ সালের পানি বণ্টন চুক্তি আমাদের স্বার্থ বিরোধী। এটির কোন গ্যারান্টি ক্লজ এবং কোন আরবিটারি ক্লোজ নেই। এ ক্ষেত্রে অন্যতম একটি সফল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। যার ফলে ৬০% পানি প্রবাহ নিশ্চিত হয়েছিল। তিনি রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করে বলেন,তারা এ বিষয়ে কোন জ্ঞান ছাড়াই কথা বলেন, যা কোন প্রভাব তৈরি করতে পারে না। তিনি বলেন, আমাদের কন্ঠ এখন স্তব্ধ। আমরা এখন নির্জীব, কাপুরুষ জাতি। আর এভাবে চললে পানির সমাধান কেন, কোন সমস্যারই সমাধান হবে না। আমরা তো ভারতের সাথে ন্যায়ভিত্তিক সমঝোতা চাই। কিন্তু দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন না থাকায় আজ এই দুরাবস্থা।
তিনি বলেন, আমাদের বুদ্ধিজীবীরা এখন পানি নিয়ে কথা বলে না। বিডিআর হত্যার নির্দেশদাতা কারা, কাদের ইন্ধনে এ হত্যাকান্ড হয়েছিল? সেসব উদঘাটন হচ্ছে না। আসলে আমাদের বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন ভরসা কেবল তরুণ প্রজন্ম। বিএনপির এই নেতা বলেন, ভাটির দেশের কোন মতামত না নিয়ে উজানের দেশ পানি প্রত্যাহার করছে। এটাই পানি সমস্যার মূল কারণ। পানি সমস্যার সুষম বন্টন করতে হলে একমাত্র সমাধান হচ্ছে অববাহিকাভিত্তিক পানি বন্টন। এ বন্টন প্রক্রিয়া একই অববাহিকায় অবস্থিত প্রত্যেক দেশকে সম্পৃক্ত করতে হবে। নেপাল-ভুটান এই দেশগুলোর সাথে আলাপ আলোচনা করে আমাদের পানি সমস্যার সমাধান করতে হবে। এ জন্য জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। তিনি ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভিন্ন চুক্তি বিষয়ে বিশেষত সামরিক চুক্তির ব্যাপারে গণভোট দেয়ার আহবান জানান।
ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি হলে আমাদের প্রতিরক্ষা হুমকিতে পড়বে মন্তব্য করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ভারত একটি যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র। তারা পাকিস্তান এবং চীনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই চুক্তির ফলে ভারতের সঙ্গে কারো যুদ্ধ হলে আমাদেরও সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে। প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে ৩৫ টির মত চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিএনপি নেতা হাফিজ বলেন, এসব চুক্তির সবগুলোই ভারতের অনুকূলে যাবে। এই সমস্ত চুক্তি থেকে অবশ্যই সরে আসতে হবে, নতুবা আমাদের সার্বোভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
বাংলাদেশের ভূখ- ব্যবহার করে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেয়া হলে বাংলাদেশে এইডস ও হেপাটাইটিসের প্রকোপ হবে মন্তব্য করে ডা. জাফরুল¬াহ্ চৌধুরী বলেন বাংলাদেশের সড়কগুলো ভারতের ভারী ট্রাক বহনের জন্য উপযোগী নয়। তিনি বলেন, ট্রানজিটের মাধ্যমে আমাদের প্রতারণা করছে। তাদের হেভি ট্রাকের জন্য আমাদের রাস্তা প্রস্তুত নয়। আবার ট্রানজিটের কারণে এইডস এবং হেপাটাইটিসের প্রকোপ হবে বাংলাদেশে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যে কোনো সামরিক চু্ক্িত হবে না বলে মনে করেন জাফরুল¬াহ চৌধুরী। তিনি বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী এতো বোকা নন, ওনার প্রজ্ঞা আছে। উনি সামরিক চুক্তি করবেন না। তিনি বলেন, ভারতের এই সফরে একটা চুক্তি করে আসুক যে, ভারত আর সীমান্তে পাখির মতো গুলী করে মানুষ মারবে না। এটাই আমার প্রধানমন্ত্রীর প্রতি পরামর্শ।
বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর সৃষ্টি দাবি করে তিনি বলেন, দেশে তারা এখন জঙ্গি খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন। মরে লাখে লাখে, শেষে দেখা যায় ওই আস্তানায় দুই জঙ্গি শিশু মরে আছে। এসব ভারতীয় ‘র’ এর প্ররোচনায় হচ্ছে। শেখ হাসিনাকে ১৯ সালের নির্বাচনে জিতিয়ে দিতেই যা খুশি তাই করাচ্ছে তারা। বিভিন্ন অভিন্ন নদী থেকে ভারতের পানি প্রত্যাহারের সমালোচনা করে এই বুদ্ধিজীবী বলেন, পানির প্রবাহে বিঘœ সৃষ্টি করা অমানবিক কাজ। ভারত এই কাজ করে মানবতাবিরোধী কাজ করছে। যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে তাদের সাথে কীভাবে এই সব চুক্তি হয়?। জাফরুল¬াহ চৌধুরী বলেন, ভারত একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। কাশ্মিরে এখন যা চলছে, ৭১ সালে বাংলাদেশেও তাই চলেছিল। এই অবস্থায় সমস্ত দেশবাসীকে এক জায়গায় না নিয়ে আসলে ভারতের কাছে নতজানু হয়ে থাকতে হবে।
এস আলম তার মূল প্রবন্ধে বলেন, ভারতের উচিত তার আধিপত্যবাদি মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে বাংলদেশের পানি সমস্যা সমাধানে আগ্রহী হওয়া। তিনি এ ব্যাপারে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তিনি আরও বলেন, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সাংবিধানিকভাবেই রাজ্য সরকারকে বাদ দিয়েও তিস্তা চুক্তি প্রণয়ন করতে পারে- যা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্বে তাদের স্বার্থে ব্যাবহার করেছিলো।
সেলিমা রহমান বলেন, বাংলাদেশের পানি বণ্টন সংক্রান্ত অবস্থান দেশের ক্ষমতার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু ভারতে এ ধরনের পরিবর্তন দেখা যায় না। তিনি বলেন, সবাইকে এ বিষয়ে একত্রিত হয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করা উচিৎ, এবং প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পূর্বে সকল শ্রেণির মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্বারকলিপি তার হাতে তুলে দেয়া উচিৎ। যা পানি ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের পানি সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সহায়তা করবে। তিনি স্বচ্ছ গণতন্ত্র ,সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যাবস্থার মধ্য দিয়ে পানি সমস্যা সমাধানে জনগণকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।
অধ্যাপক ড দিলারা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, যা সবার হৃদয়কে আলোড়িত করে। কিন্তু এ থেকে উত্তোরণের পথ খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারত যাচ্ছেন। তিনি সেখানে যাতে আমাদের দাবিগুলো উপস্থাপন করেন সেজন্য তার ভারত যাওয়ার আগে আজকের এই সেমিনার। আসুন আমার সমস্যার সমাধানে ঐক্যবদ্ধ হই। সবাই স্বাক্ষর তুলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করি এবং তার হাতকে শক্তিশালী করি।
ওবায়দুর রাহমান বলেন, বাংলাদেশের পানির ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় ভারতের সাথে দরকষাকষির ক্ষেত্রে পানি বিশেষজ্ঞ, পররাষ্ট্র এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ব্যাক্তিবর্গ এবং রাজনীতিবিদদের দক্ষতার উপর গুরুত্তবারোপ করেন। তিনি ইউরোপের ন্যায় অববাহিকা ভিত্তিক পানি কমিশন আমাদের এই অঞ্চলে গঠনের প্রস্তাব করেন। তিনি আরও বলেন করার আছে বহু কিছু । কিন্তু বলতে পারেন আমরা ভারতের সামনে অসহায়। একটা সরকারের টিকে থাকা যদি ভারতের সমর্থনের উপর নির্ভর করে তাহলে কোনভাবেই কিছু সম্ভব না। বর্তমান সরকার যে দেশপ্রেমহীন তা আমরা বলতে পারি না। সরকারের অবশ্যই দেশপ্রেম থাকার কথা। যদি সরকার ভারতের সাথে আলোচনায় উত্থাপন করতে পারে যে এই ব্যাপারে দেশের মানুষের প্রচন্ড চাপ আছে, তাহলেই হবে। সেক্ষেত্রে আমাদেরও সরকারের কাছে যৌক্তিক ভাবে স্বারকলিপি দিতে হবে। ফলোআপ আলোচনা করতে হবে।

http://www.dailysangram.com/post/278696-