সুনামগঞ্জে বাঁধ ভেঙ্গে হাওড়ে পানি ঢোকার দৃশ্য
৬ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:০২

সুনামগঞ্জে দেড় লক্ষাধিক হেক্টরের বোরো ফসল পানির নিচে ॥ ৩ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি

অব্যাহত বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ী ঢলে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে সুনামগঞ্জে প্রায় দেড় লক্ষাধিক হেক্টর বোরো জমির ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেছে। জেলার ১১ উপজেলার ছোট বড় প্রায় ১৪ শত ফসলী হাওরের ৯০ ভাগ ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে পানির নিচে নিমজ্জিত হয়েছে। এতে ২৬ লক্ষ জনসংখ্যার এ জেলায় ১৬ লক্ষ কৃষক তাদের একমাত্র বোরো ফসল হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে সরকার কর্তৃক অর্ধশত কোটি টাকা বরাদ্ধ থাকলেও পাউবোর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও পিআইসিরা সিংহভাগ টাকা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। ফলে সময়মত বাঁধ মেরামত না করায় বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ী ঢলের প্রথম ধাক্কাতেই ভেঙ্গে গেছে প্রায় সবকটি ফসল রক্ষা বাঁধ। গত ৩/৪ দিনে কৃষকের চোখের সামনে একে একে তলিয়ে গেছে সুনামগঞ্জের সবকটি ফসলী হাওর। কৃষিনির্ভর এ জেলার কৃষকেরা একমাত্র বোরো ফসল হারিয়ে দুচোখে এখন শুধুই অন্ধকার দেখছেন।
এদিকে ফসলহানির এ দুর্যোগের সময় এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা চাউলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি করে মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। জেলা সদরসহ বিভিন্ন বাজারে ৩দিন আগে ৫০ কেজি চালের বস্তার যে মূল্য ছিল ২১শ টাকা বর্তমানে তা ২৮শ থেকে ৩ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। একইভাবে ৫০ কেজির আটার বস্তা ১ হাজার/১১শ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫শ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বার বার মাইকিং করেও মূল্য বৃদ্ধির এই সিন্ডিকেট ভাঙ্গা সম্ভব হচ্ছে না।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোঃ জাহেদুল হক জানিয়েছেন এ বছর জেলার ১১ উপজেলায় ২ লক্ষ ২৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ করা হয়েছে এবং ৮ লক্ষ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এর সূত্র মতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সুনামগঞ্জ জেলায় প্রায় ১ লক্ষ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়েছে। তবে বাস্তবে এই চিত্র ভিন্ন। সরকারি হিসাবের চেয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। হাওর বাঁচাও কৃষক বাঁচাও আন্দোলনের নবগঠিত কমিটির আহবায়ক এডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু বলেছেন, কৃষি সম্প্রসারণের তথ্য হাস্যকর। তার মতে ৯০ ভাগ ফসল ইতোমধ্যেই তলিয়ে গেছে।
জেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষক ও জনপ্রতিনিধিদের দেয়া তথ্য মতে জেলার বৃহৎ হাওরগুলির মধ্যে দেখার হাওর, মাটিয়াইন হাওর, খরছার হাওর, নলোয়ার হাওর, চন্দ্র সোনার তাল হাওর, টগার হাওর, গোরমার হাওর, হালির হাওর, মইয়ার হাওর, সোনামড়ল হাওর, ধানকুনিয়ার হাওর, চাপতির হাওর, বারাম হাওর, টাংনির হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওরসহ ছোট বড় ১২শ হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে প্রায় দেড় লক্ষাধিক হেক্টর বোরো জমির ফসল পানিরে নিচে তলিয়ে গেছে। বেসরকারি হিসাবমতে যার আনুমানিক ক্ষতির পরিমান ৩ হাজার কোটি টাকা।
বর্ধিত গোরমা হাওর পাড়ের রামসিংহপুর গ্রামের কৃষক আলীমুল জানান, তাদের হাওরের গলগলিয়া বাঁধ ভেঙ্গে প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এ বাঁধ নির্মাণের জন্য সরকারি বরাদ্দ এসেছে ১৪ লক্ষ ৯১ হাজার ৪৭৭ টাকা। প্রকল্প কর্মকর্তা স্থানীয় দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিশ্বজিৎ সরকার মাত্র হাজার বিশেক টাকার মাটি ফেলে বাদবাকি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বাঁধে যে পরিমাণ বরাদ্দ এসেছে সম্পূর্ণ টাকার কাজ করা হলে বাঁধ ভাঙ্গার প্রশ্নই উঠে না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। এ অবস্থা সকল ঠিকাদার ও প্রকল্প কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেই। সিন্ডিকেট কমিশন কাটতে কাটতে বাঁধে মাটি ফেলার জন্য কোন টাকাই আর অবশিষ্ট থাকে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইউপি সদস্য জানিয়েছেন, ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার মধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসে ২০% হিসাবে ৩০ হাজার টাকা, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে ৩০% হিসাবে ৪৫ হাজার টাকা এবং স্থানীয় প্রকল্প সদস্যদেরকে আরো ২৫ হাজার টাকা উৎকোচ দিয়ে বাঁধের কাজের জন্য তার কাছে অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র ৫০ হাজার টাকা। তার মধ্যে ধারদেনা করে কমিশনের টাকা অগ্রিম পরিশোধ করতে হয়েছে। এ অবস্থায় কাজ করিয়ে নিজেরও কোন উপকার হয়নি বাঁধেও ঠিকমত মাটি কাটা সম্ভব হয়নি। এই অবস্থা জেলার সকল ফসল রক্ষা বাঁধের ক্ষেত্রেই। পাউবো’র কর্মকর্তাদের সীমাহীন দুর্নীতি ঠিকাদার ও প্রকল্প কর্মকর্তাদের সামান্য লোভের কারণে নিঃশ্ব হয়ে পড়েছেন জেলার ১৬ লক্ষ কৃষক। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আফছার উদ্দিন জানিয়েছেন, ফসল রক্ষা বাঁধ মেরামতের জন্য বরাদ্ধকৃত ৫২ কোটি টাকার মধ্যে বড় বাঁধ নির্মাণের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরকে প্রকল্প কর্মকর্তা করে এক বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য ঠিকাদারদেরকে যথাক্রমে ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ৩১ মার্চের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার জন্য বরাদ্ধ বন্টন করা হয়েছে। কোথাও অনিয়ম হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড এর দুর্নীতি, ঠিকাদার ও পিআইসিদের বাঁধের টাকা আত্মসাতের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে কৃষকসহ সুনামগঞ্জের সর্বস্তরের জনতা। বিভিন্ন শে্িরণপেশার মানুষ কৃষকদের এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করায় ফসল রক্ষার বাঁধ নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তীব্রতর হচ্ছে আন্দোলন। দুর্নীতি বিরোধী এই আন্দোলন। গতকাল বুধবার বিকাল ৩ ঘটিকায় সুনামগঞ্জ শহরের ট্রাফিক পযেন্টে ফসল রক্ষা বাঁধের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলার জাতীয় পার্টির উদ্যোগে আয়োজিত এই সভায় সাবেক সংসদ সদস্য এডভোকেট আব্দুল মজিদ এর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সুনামগঞ্জ সদর আসনের সংসদ সদস্য সাংবাদিক ও আইনজীবী এডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিছবাহ। এর পূর্বে জামালগঞ্জ উপজেলার হালির হাওর পাড়ের কৃষকেররা উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস ঘেরাও করে রাখেন। পরে তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে স্মারকলিপি প্রদানসহ প্রতিবাদ সমাবেশে মিলিত হয়। একই দাবিতে দেখার হাওর পাড়ের কৃষকেরা দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার শান্তিগঞ্জ বাজারে সিলেট সুনামগঞ্জ রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। হাওর রক্ষা বাঁধের টাকা আত্মসাৎকারী দুর্নীতিবাজদের শাস্তি ও সুনামগঞ্জ জেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করার দাবিতে সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবি সমিতি মানব বন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে।
কিশোরগঞ্জের হাওড় অঞ্চল নিমজ্জিত কৃষকদের মাথায় হাত
কিশোরগঞ্জ সংবাদাতা : সাম্প্রতিক টানা বর্ষণ আর ভারতীয় পাহাড়ি ঢলে কিশোরগঞ্জ জেলার বিশাল হাওড় অঞ্চলে অকাল বন্যায় বোরো ধানের জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মাঠের পর মাঠ তলিয়ে যাওয়ায় জেলার হাজার হাজার কৃষক পরিবারে হতাশা নেমে এসেছে। কৃষি বিভাগ ও বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের হিসাব অসুযায়ী ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলী উপজেলার প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে। ইটনা উপজেলার রায়টুটি ইউনিয়নের তলার হাওড়, বর্শিকুড়া, থানেশ^র, বড়চাপড়া, মিঠামইন উপজেলার বিজয় বাধ হাওড়, অষ্টগ্রাম উপজেলার বাঙ্গালপাড়া, আদমপুর, আব্দুল্লাহপুর, কদমচাল হাওড়ের সকল জমি তলিয়ে গেছে। এসকল জমি থেকে ৮০ হাজার মেট্রিকটন চাল উৎপাদিত হতো বলে জানা যায়। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। হাওড়ের প্রধান একটিমাত্র ফসল বোরো ধান। এই বোরো ধান উৎপাদন বিঘিœত হলে হাওড়ের কৃষকদের মেরুদন্ড ভেঙ্গে যায়। এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক হাওড়ের ক্ষতিগ্রস্থ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন।

http://www.dailysangram.com/post/278700-