৬ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৭

ফের ঋণ করে কেনা হচ্ছে উড়োজাহাজ

কানাডার ঋণে আরো তিনটি উড়োজাহাজ কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ উদ্দেশ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটিও গঠন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিমান কর্তৃপক্ষের ভেতরে-বাইরে নানা আলোচনা ডালপালা মেলছে। কারণ দিনে দিনে বিমানের দেনা বেড়েই চলেছে। বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা করে ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে সংস্থাটিকে। এমনকি ১৯৮৪ সালে কেনা তিনটি ডিসি-১০ কেনার টাকা এখনো পরিশোধ হয়নি। অথচ ডিসি-১০ অনেক আগেই বহর থেকে বাতিল হয়ে গেছে। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এর আগে চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর ও চারটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ কেনার জন্য দেশ-বিদেশের কয়েকটি ব্যাংক থেকে ৯ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। এখনো এর অনেক টাকা পরিশোধ বাকি। বিমানকে কম্পানিতে রূপান্তর করার পর লাভজনক হয়েই আবার লোকসানের পথে হাঁটছে সংস্থাটি।
এ প্রসঙ্গে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দিক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যাত্রীসেবার মান বাড়াতে আমরা বদ্ধপরিকর। যে কটি উড়োজাহাজ আছে তা দিয়ে ফ্লাইট চালাতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। এর জন্যই আরো কয়েকটি উড়োজাহাজ কেনার চেষ্টা চলছে। সরকার আমাদের নানাভাবে সহায়তা করছে। যেসব দেশ আমাদের কাছে অর্থ পাবে তা আগে পরিশোধের চেষ্টা চালাচ্ছি। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আশা করি, আগামী বছর নাগাদ আগের উড়োজাহাজের সঙ্গে নতুন কয়েকটি যোগ হবে। আর্থিকভাবে বিমানকে আরো চাঙ্গা করতে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে কেউ দুর্নীতি বা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
বিমান সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন দেশ থেকে ঋণ নিয়ে উড়োজাহাজ কেনা হচ্ছে। এর মধ্যে কোনোটির ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছে, আবার কোনোটির ক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে না। উড়োজাহাজ সংকটের কারণে রুটের সংখ্যা কম। যে কারণে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর সঙ্গে কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। সম্প্রতি বিমান পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিদেশি এয়ারলাইনসের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ছাড়া টিকে থাকার উপায় নেই। সে কারণেই কয়েকটি উড়োজাহাজ কেনা জরুরি। তা ছাড়া সংস্থার বদনাম যেভাবেই হোক ঘোচাতে হবে। সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলার বিকল্প নেই। বিমানের প্রতিটি সেক্টরকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে।
সূত্র জানায়, ২০১৮ বা ২০১৯ সালের মধ্যে জি টু জি (সরকার থেকে সরকার) পদ্ধতিতে কানাডার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তিনটি উড়োজাহাজ কেনা হবে। উড়োজাহাজগুলো বোম্বার্ডিয়া কম্পানির ড্যাশ ৮-কিউ ৪০০ মডেলের। প্রতিটি উড়োজাহাজের বাজারমূল্য ৩১ দশমিক ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির তদারকি করবেন বিমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) এনামুল বারী। এ প্রসঙ্গে বিমানের পরিকল্পনা শাখার এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কানাডিয়ান কমার্শিয়াল করপোরেশন (কেসিসি), এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট কানাডা (ইডিসি) ও বোম্বার্ডিয়া কম্পানির সঙ্গে দর-কষাকষি করা হবে। আশা করি, অল্প সময়ের মধ্যে সব কিছু চূড়ান্ত হয়ে যাবে। ’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঋণ নেওয়া ছাড়া কোনো কিছুই কেনা সম্ভব নয়। অনেক আগের ঋণ এখনো পরিশোধ করা যায়নি, এ কথা সত্য। ওই ঋণ কবে শোধ হবে তা বলতে পারছি না। ’
১৯৮৪ সালের ঋণই শোধ হয়নি : ১৯৮৪ সালে তিনটি ডিসি-১০ উড়োজাহাজ কেনা হয়। এর জন্য আটটি বিদেশি ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক লন্ডন শাখা থেকে ৬৪.৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া হয়। ২৯ বছর সেগুলো সার্ভিসে ছিল। ২০১৩ সালে উড়োজাহাজগুলো বাদ দেওয়া হয়। এখনো ওই ঋণের ২২১ কোটি ৬৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকা পরিশোধ হয়নি। মাস দুয়েক আগে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, ডিসি-১০ বিমান কেনার পর নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করা হচ্ছিল। মাঝখানে তা বন্ধ ছিল। এখন আসল বকেয়া আছে ১৯১ কোটি ২৫ লাখ ৪৩ হাজার ৭৫ টাকা। আর সুদ হয়েছে ৩০ কোটি ৩৮ লাখ ৮৭ হাজার ৪৮৮ টাকা।
বিদেশি স্টেশনগুলোতে চলছে দুর্নীতি, অনেকগুলো বন্ধের উপক্রম : বিমানের বিদেশি স্টেশনগুলো দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঠিকভাবে অফিসও করছেন না। তা ছাড়া কমিশন বাণিজ্যেরও অভিযোগ আছে বিস্তর। বিশেষ করে জেদ্দা ও লন্ডনের ম্যানচেস্টার স্টেশনে বেশি অনিয়ম হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ওই সব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। টাকা আত্মসাত্সহ নানা অনিয়মের অভিযোগে জেদ্দা স্টেশনের কর্মকর্তা আবু তাহেরকে বছরখানেক আগে দেশে ফেরত আনা হয়। বর্তমানে বিশ্বের ১৮টি দেশে বিমানের বৈদেশিক অফিস বা স্টেশন রয়েছে। বেশির ভাগ স্টেশনে কান্ট্রি ম্যানেজার, স্টেশন ম্যানেজারসহ অনেক স্টাফ আছেন। ম্যানচেস্টার স্টেশন নানা অনিয়মের কারণে বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে।
খামখেয়ালির কারণে দাম্মামে বিমান নষ্ট ২৬ দিন : দাম্মাম বিমানবন্দরে ‘রাঙ্গাপ্রভাত’ নামের উড়োজাহাজটি ২৪ দিন নষ্ট হয়ে পড়ে ছিল। অথচ এক দিনেই সেটি মেরামত করা যেত। বিমান কর্তৃপক্ষ অজুহাত হিসেবে বলেছে, ভিসা জটিলতায় প্রকৌশলীরা দাম্মামে যেতে পারেননি। জানা গেছে, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ইঞ্জিনে পাখির আঘাত লাগায় উড়োজাহাজটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত ১৪ মার্চ ইঞ্জিনিয়ার রুহুল কুদ্দুস ফারুকের নেতৃত্বে একটি দল গিয়ে সেটি ঠিক করে। বিমানের জেনারেল ম্যানেজার (জনসংযোগ) শাকিল মেরাজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ভিসা জটিলতার কারণে প্রকৌশলীদের দাম্মাম যেতে দেরি হয়েছে। বিমানের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, খামখেয়ালিপনা করেই বিমানকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে ভ্রমণে এখন অনেকেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না মূলত শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে। এর সঙ্গে আছে আন্তর্জাতিক মানের যাত্রীসেবার অভাব।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/04/06/483358