৬ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৩৯

এ লজ্জা গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের

বিবিধ প্রসঙ্গ

|| মাসুদ মজুমদার ||

বিগত ৯ মাসে ১০টি চরমপন্থীবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়েছে। গুলশানের হোলে আর্টিজান থেকে কুমিল্লার কোটবাড়ি পর্যন্ত অভিযানগুলো প্রচুর প্রচার পেয়েছে; কিন্তু জনগণকে আশ্বস্ত করেনি। এ ছাড়া বিচ্ছিন্নভাবেও কিছু অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এসব অভিযানে এ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক উগ্রবাদী চরমপন্থী নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। কিছু দিন যাবৎ আত্মঘাতীদের তৎপরতার বিষয়টি পুলিশ সামনে এনেছে।
আতিয়া মহলে আত্মঘাতীদের লাশের গন্ধ তখনো ছড়াচ্ছিল, বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল বেশ ক’দিন। কিন্তু অনেক প্রশ্নের জবাব মিলছিল না। এর মধ্যেই খবর রটল, মৌলভীবাজারের নাসিরপুরে উগ্রপন্থী ও আত্মঘাতীদের নতুন আস্তানার সন্ধান মিলেছে। আরো সন্ধান মিলেছে কুমিল্লার কোটবাড়ি এলাকায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে এত জঙ্গি আস্তানার বিষয়টি জনমনে ব্যাপক সংশয় জাগিয়েছে। ১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি কান যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। অবশেষে মৌলভীবাজারের নাসিরপুরে চরমপন্থী আস্তানায় সোয়াতের অভিযান শুরু হলো। ‘অপারেশন হিট ব্যাক’-এর আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির পর ছিন্ন ভিন্ন লাশ মিলল চার শিশু, দুই নারী ও এক পুরুষের। বলা হলো, অভিযানে সাত থেকে আট ‘জঙ্গি’ নিহত হয়েছে। এরা আত্মঘাতী। বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে। কিরিটি রায় কিংবা রবিন হুড কেন, এই যুগের সব থ্রিলার কাহিনীর স্রষ্টারা তাজ্জব না হয়ে যাবেন কোথায়! বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবগতভাবে চরমপন্থী নয়, উগ্রপন্থীও নয়। ধার্মিক মানুষের এই জনপদের প্রায় প্রত্যেকটি মানুষ অসাম্প্রদায়িক এবং যেকোনো প্রান্তিক চিন্তা মুক্ত।
আতিয়া মহলকে ঝাঁঝরা করে যা মিললÑ তার কোনো অঙ্ক মিলাতে পারছি না। বড়হাটে অভিযান শেষ হলো এক নারী ও দুই পুরুষ নিহত হওয়ার সংবাদসহ। সিলেটের শিববাড়ির আতিয়া মহলে আমরা হারালাম র্যাব গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদকে। তাকে চটজলদি সিঙ্গাপুরে কেন নেয়া হলো, আবার সিএমএইচে কেন আনা হলো, তারও কোনো উত্তর মেলাতে পারছি না। জবাব মিলছে না একজন ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হওয়ার ব্যাপারেও, তিনি কি বোমা কুড়াতে গেলেন? না পুলিশকে সাহায্য করতে গেলেন। যেমনি জবাব খুঁজে পাচ্ছি না চট্টগ্রামে ছাত্রদল নেতার মৃত্যু রহস্যের। তুলে নেয়ার মাত্র ১২ ঘণ্টা পর তার লাশ মিলল হাত-পা ও চোখ বাঁধা গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। সরকার ও রাষ্ট্রকেই প্রমাণ করতে হবে ছাত্রদল নেতা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার নন। নয়তো তার লাশও আমাদের বিবেকের বদ্ধ দুয়ারে লাথি মারবে, আইনের শাসনের ব্যাপারে ক্ষোভের থুথু ছিটাবে। মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখে বিবেক আত্মহনন করতে চাইবে। তার খুনি চিহ্নিত করার দায়ও সরকারের ওপর বর্তায়। এসব ব্যাপারে সরকার যেন নিরুত্তাপ।
এক দিকে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে ধানের শীষ ও নৌকার মর্যাদার লড়াইয়ের টানটান উত্তেজনা। অন্য দিকে, পরপর কয়েকটি উগ্রবাদী বা চরমপন্থী দমন অভিযান। জনগণ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল। দিন শেষে কুমিল্লা নির্বাচনের যোগ-বিয়োগ মিলাতে কারো অসুবিধা হয়নি। ক্ষোভ ও প্রতিবাদের নীরব ‘ভোটবিপ্লব’ ঘটে যাওয়া অসম্ভব ছিল না। অনেকেই এমনটিই আশা করেছিলেন। কিন্তু পরপর কয়েকটি চরম ও উগ্রপন্থী দমনের অভিযান কী প্রসব করল, জনগণ এর কোনো ফলাফল মিলাতে পারল না। দিনের পর দিন পুলিশি নজরদারি এড়িয়ে চারটি শিশু ‘জঙ্গি’, দু’জন নারী ‘জঙ্গি’ আতিয়া মহলকে অস্ত্র-বারুদের গুদাম বানিয়ে ফেলল! সাহায্য নিলো মাত্র একজন পুরুষের। বেশ ক’বার মনে হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হোম ওয়ার্ক করেছে। কিন্তু ঘটনাটা বিশ্বাসযোগ্য করে উপস্থাপন করতে পারেনি। এটাও যেন ‘ক্রসফায়ার গল্প’। বাংলাদেশে শীর্ষ চরমপন্থী শায়খ আবদুর রহমানের গ্রেফতার অভিযান এবং বাংলাভাইকে জালে আটকানো জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। হোলে আর্টিজানেও বিশ্বাসের চিড় ধরেনি। কিন্তু আতিয়া মহল থেকে কুমিল্লার কোটবাড়ি যতটা গর্জেছে ততটা বর্ষেছে কি? কেন বর্ষালো না? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সাথে জঙ্গি অভিযানের কোনো সম্পর্ক নেই। কয়েক দিন যাবৎ কানাঘুষা চলছিল, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও নিরাপত্তা চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের অভিযান চলতেই থাকবে। কান খাড়া করে মিল খোঁজার চেষ্টা করলাম। জোর করে মিলানো যায় কিন্তু যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। কুমিল্লায় অভিযানস্থলে গোলাবারুদ আছে, উগ্রপন্থী বা আত্মঘাতী নেই। এখানেও জোড়াতালি দিয়ে অঙ্ক মিলানো যায়, ফর্মুলা মিলানো যায় না। গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ও পুলিশি নজরদারির সুফল মিলল কোথায়?
প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করলেনÑ আইনের শাসন নিশ্চিত না হলে উন্নয়নের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলে না। তার মন্তব্যের গভীরতা মাপতে গিয়ে বুঝতে চাইলাম, সরকার আইনের শাসনের প্রতি এতটা নির্লিপ্ত থাকছে কেন? বিবেককে প্রশ্ন করলে বারবার জবাব মিলছেÑ গুম, অপহরণ ও ক্রসফায়ারের নতুন ধরন যেন ‘তুলে নিয়ে যাওয়া’। গত দুই সপ্তায় দেশের একাধিক এলাকা থেকে বেশ ক’জন মানুষকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তুলে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে ঝিনাইদহে পাঁচজন, চট্টগ্রামে তিনজন ও নওগাঁ থেকে তিনজন ছাড়াও রাজশাহীর বাগমারা থেকে একজনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠছে অনেক আগে থেকে। রাউজানে কর্ণফুলী নদীর তীর থেকে ছাত্রদল নেতার হাত-পা ও চোখ বাঁধা গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনাও নতুন নয়। এভাবে তুলে নিয়ে লাশ করে দেয়ার অপ ও জংলি সংস্কৃতি অনেক দিন যাবৎ চলছে। তুলে নিয়ে কিছু দিন গায়েব করে রেখে পরে মামলা করার নজিরও কম নেই। এতে উচ্চ আদালতের নির্দেশ এবং প্রতিষ্ঠিত আইনÑ দুটোই অবজ্ঞা করা হচ্ছে।
অন্য দিকে, চরমপন্থী আস্তানা চিহ্নিত করে পরিচালিত কয়েকটি অভিযানে বেশ কয়েকটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। মৌলভীবাজারে সাতটি দেহ ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পাওয়ার তথ্য সবাই জেনেছেন। বলা হচ্ছে, এরা ছিল আত্মঘাতী এবং উগ্রপন্থী, নিজেদের বোমা কিংবা জমাট করা বারুদেই তাদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তাহলেও প্রশ্ন ওঠে, চরমপন্থীদের জীবিত গ্রেফতারের টার্গেট কি ছিল না। অভিযানগুলো লাশ গুনে সমাপ্ত হচ্ছে। জাতি জানতে পারছে না, ঘটনার পেছনের ঘটনা আসলে কী! জঙ্গিরা কেমন জঙ্গি, তা-ও অজানা থেকে যাচ্ছে।
একসময় ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার যে গল্প বলা হতো সেটা যেমন জনগণকে স্বস্তি দেয়নি, আশ্বস্ত করেনি, তেমনি ‘জঙ্গি আস্তানার’ বিষয়টিও জনমনে নানা ধরনের সংশয়ের জন্ম দিয়েছে। জনমনে সৃষ্ট সন্দেহ ও সংশয় দূর করা সরকারেরই দায়িত্ব। উগ্রপন্থী কিংবা চরমপন্থীদের দমন, গ্রেফতার ও আইনের আওতায় আনার জন্য অভিযান অবশ্যই চালাতে হবে। কিন্তু এত অভিযান জনগণকে জিজ্ঞাসু করে তুলেছে। জনগণ আশ্বস্ত হতে চায়, এসব অভিযান বিচারবহির্ভূত হত্যার নয়া কোনো কৌশল নয়। এখন পর্যন্ত উগ্র বা চরমপন্থী এমন কাউকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি, যাকে দেখে জনগণ আশ্বস্ত হতে পারে এবং বলতে পারেÑ সরকার যা করছে তাতে উগ্র ও চরমপন্থীদের হঠকারিতার মোক্ষম জবাব দিচ্ছে। গোয়েন্দারা তথ্য নিয়ে উপকৃত হওয়ার সুযোগও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বরং লাশ করে উপস্থাপন হত্যা নাকি আত্মঘাতীর আত্মহত্যা, সেটা পরিষ্কার হচ্ছে না। জনগণ উগ্রপন্থী সম্পর্কেও সঠিক ধারণা পাচ্ছে না।
পূর্বাপর বলে আসছিÑ বিচারবহির্ভূত হত্যা যে কৌশলেই হোক, কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। রাষ্ট্র কোনো নাগরিককে বিচার না করে লাশ বানিয়ে উপস্থাপন করতে পারে না। যত বড় অপরাধী হোক, তাকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। অথচ অনেক গুম ও অপহরণের ঘটনা ঘটল, রাষ্ট্র না দায় নিলো, না আশ্বস্ত হওয়ার মতো জবাবদিহি করল। ক্রসফায়ার চলল দিনের পর দিন। জনগণ বিশ্বাস করল না। এখন বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে লাশ ফেলে দেয়া হচ্ছে। আবার অভিযান চালিয়ে জীবিত উদ্ধার করার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে।
কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় রাষ্ট্র ও সরকার এড়াতে পারে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপহরণ, গুম, তুলে নেয়া কিংবা ক্রসফায়ারের সাথে সংশ্লিষ্ট না হলে কারা এত বড় অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছেÑ সেটার দায়ও সরকারকেই নিতে হবে। জনগণ দেখল, একজন চৌকস হিসেবে পরিচিত র্যাব গোয়েন্দা কর্মকর্তা লাশ হয়ে বিদায় নিলেন। এই ক্ষতি অসহনীয়। যেমনি অসহনীয় রাষ্ট্রের সন্তানতুল্য নাগরিকের হত্যা। প্রতিটি মানুষের প্রাণ সৃষ্টিকর্তার দেয়া আমানত। তাদের হাড়-গোড় ছিন্নভিন্ন দেহও একসময় বিচারের জন্য যে, আহাজারি করবে না সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? বিচারের আগে দোষী সাব্যস্ত করা যেমন আইনের শাসনের প্রতি চ্যালেঞ্জ, তেমনি যে কৌশলেই হোক বিচারবহির্ভূত হত্যামাত্রই আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন।
গণতন্ত্রহীনতার মাঝেই ঢাকায় আইপিইউর আসর বসেছে। আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ চলতি সংসদ এবং এর সদস্যরা দেশ-জাতির কোনো মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেননি। বিশ্বসম্প্রদায় আসর বসিয়ে বরং বাংলাদেশের মানুষের লজ্জা বাড়িয়েছে। মানবাধিকার দলনে জনগণ বিব্রত ও অস্বস্তিতে রয়েছে। আইনের শাসনের অভাব সর্বত্র মুখ ব্যাদান করে জানান দিচ্ছে জনগণের অসহায়ত্বের কথা। তার ওপর, চেয়ারে বসার পর কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাজশাহী, সিলেট ও হবিগঞ্জের নির্বাচিত মেয়রদের পুনঃবরখাস্ত করা হলো। এক দিন পর বরখাস্ত হলো আরো পাঁচ স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের এসব প্রতিনিধির সম্ভবত বড় অপরাধ, এরা বিরোধী দল সমর্থিত। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানালেন, তিন মেয়রের বরখাস্তের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী জানেন না। এই ধরনের ছেলে ভুলানো বক্তব্য ভুলের মাশুল কমায় না, বাড়ায়। মামলার বরাত বাহানা মাত্র। এটা আরেক লজ্জা। জাতি এত লজ্জা লুকাবে কিভাবে?
masud2151@gmail.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/209856