৪ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:২৮

মেয়রদের বরখাস্তে সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত

সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার নির্বাচিত মেয়রদের বরখাস্তের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের রায় উপেক্ষার এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সাময়িক বরখাস্ত সংক্রান্ত যে বিতর্কিত অর্ডার ইস্যু করে তা ‘আইনগত কর্তৃত্ব ছাড়াই’ করা হয়, ফলে এর কোন ‘আইনগত কার্যকারিতা’ নেই বলে আদালত ঘোষণা করেছে। অথচ গত রোববার রাজশাহী, সিলেট ও হবিগঞ্জের মেয়রকে সাময়িক বরখাস্ত করে ‘কু-দৃষ্টান্ত’ স্থাপিত হলো বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দাবী করেন, ‘এই ধরনের মেজর পলিসি ডিসিশনের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী জানেন না।’
গতকাল গণমাধ্যমের মূল আলোচিত বিষয় ছিলো তিনজন মেয়রকে একসঙ্গে বরখাস্ত করার স্থানীয় সরকারের চিঠি। রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেনকে রোববার (২ এপ্রিল, ২০১৭) স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনটি এরূপ : ‘মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১, রাজশাহী এর মামলা নং- ১৩৬/১৫ (রাজশাহী জেলার বোয়ালিয়া থানার মামলা নং- ১৭, তারিখ- ৮ ফেব্রুয়ারি’২০১৫/এম.জি.আর- ১০৩/১৫ বোয়ালিয়া মডেল থানা) এর অভিযোগপত্র বিজ্ঞ আদালত কর্তৃক গৃহীত হইয়াছে। সেহেতু, স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯, (২০০৯ সালের ৬০ নং আইন) এর ধারা ১২ এর উপধারা (১) এ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলায় অভিযোগপত্র আদালত কর্তৃক গৃহীত হইলে, সরকার কর্তৃক লিখিত আদেশের মাধ্যমে তাহাকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের বিধান রহিয়াছে। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেনকে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯, (২০০৯ সালের ৬০ নং আইন) এর ধারা ১২ এর উপধারা (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হইল। জনস্বার্থে জারিকৃত এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হইবে। ’অথচ স্থানীয় সরকারের এই আইনটি উচ্চ আদালতে বাতিল ও অকার্যকর হয়ে যায়। মোহাম্মদ মোসাদেক হোসেন বনাম বাংলাদেশ সরকারের মধ্যকার রিট পিটশনের প্রেক্ষিতে গত ১০ মার্চ ২০১৬ হাইকোর্ট যে আদেশ দেন তার বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ আপিল করে। সর্বশেষ গত ৫ মার্চ ২০১৭ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের সাময়িক বরখাস্তের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রাখেন। হাইকোর্টের সেই আদেশে বলা হয়, ২০০৯ সালের স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইনের ১২(১) ধারার বলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সাময়িক বরখাস্ত সংক্রান্ত যে বিতর্কিত অর্ডার ইস্যু করে তা আইনগত কর্তৃত্ব ছাড়াই করা হয়, ফলে এর কোন আইনগত কার্যকারিতা নেই। হাইকোর্টের এই আদেশে সরকারকে এসংক্রান্ত বিধি-বিধান সংশোধন করার জন্য বলা হয়। এছাড়া নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের বরখাস্ত করার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য বিধি তৈরির জন্যও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। উল্লেখ্য, গত ২৭ মার্চ ২০১৭ তারিখে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মাহমুদুল আলম স্বাক্ষরিত ‘মহামান্য আদালত কর্তৃক আদেশ প্রতিপালন’ শীর্ষক এক পত্রে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের দায়েরকৃত আপিলের আদেশ কার্যকরের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশও প্রদান করা হয়। এর অনুলিপি মেয়র ও ভারপ্রাপ্ত মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছাড়াও রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকসহ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রদান করা হয়। সর্বোচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট এই রায় কার্যকর করতে মন্ত্রণালয়ের চিঠি ইস্যু করার পরও কী করে একই জায়গা থেকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রদান করা হয়- তা বুঝে উঠতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। এটা নিছক আদালত অবমাননা- নাকি মহল বিশেষের সরকারকে বেকায়দায় ফেলে ফায়দা লোটার অপচেষ্টার অংশ তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
রাজশাহীর মেয়রের প্রতিক্রিয়া : এবিষয়ে রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট যেই অর্ডার বা আদেশ দিয়েছেন-তাতে আগামী নির্বাচনের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আমাকে আর বরখাস্ত করা যাবে না। আদালতের নির্দেশের পরে সরকারের গণতন্ত্র পরিপন্থি যেই কর্মকাণ্ড ছিল, সেগুলো আর ঘটতে পারে না। আমি স্থানীয় সরকারের এই বিভাগকে (রাসিককে) শক্তিশালী করার চেষ্টা করছি। কিন্তু বর্তমান যে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে- তা দেশের জন্য অশনি সংকেত।’ তিনি বলেন, ‘আইনের মধ্যে দিয়েই আমার বরখাস্তের আদেশ সর্বোচ্চ আদালতে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তাই আমার বিরুদ্ধে রাজশাহী শহরে যদি রাজনৈতিক বা সামাজিক কারণে ৫০টিও মামলা হয় তার জন্য আমাকে বরখাস্ত করা যাবে না। কিন্তু সরকার আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আমাকে আবারো বরখাস্তের আদেশ দিয়েছেন।’ তবে বরখাস্তের আদেশকৃত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় দফার ফ্যাক্স সম্পর্কে মেয়র বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের আদেশবলে আমি এখন থেকে মেয়র। আদালত থেকে পরবর্তি কোনো নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত আমি নিয়মিত অফিস ও দায়িত্ব পালন করবো। যেহেতু আমার কাছে কোনো ফ্যাক্স/চিঠি আসেনি- এটা আদালতের কোনো আদেশ নয়। এটা সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক ফ্যাক্স। এর আইনগত বৈধতা নেই। কাজেই আমি আমার দায়িত্ব পালন করবো। আমাকে স্থানীয়ভাবে কেউ বাধা দিলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আমি ব্যবস্থা নিবো।’
ওবায়দুল কাদেরের প্রতিক্রিয়া : সিলেট ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এবং হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়রকে বরখাস্তের সিদ্ধান্তটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিষয় বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি জানান, এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো যোগসূত্র নেই। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিষয়টি জানেন না বলেও দাবি করেন তিনি। গতকাল সোমবার দুপুরে রাজধানীর ডেমরায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিয়েছে। এর পেছনে যুক্তি কী, কারণ কী- এটা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। তবে আমি যতটুকু জানি, এই ধরনের মেজর পলিসি ডিসিশনের বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানেন না।’

http://www.dailysangram.com/post/278395-