৪ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:২৬

লাগামহীন চালের বাজার

লাগামহীনভাবে বাড়ছে চালের বাজার। এতে বিপাকে পড়ছে নি¤œ আয়ের মানুষ। ধান আসতে দেরি হবে এমন অজুহাতে মিল মালিকদের অবৈধ মজুদে বাড়ছে বাজার। মিলার কারসাজিতে মোটা চালে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চিহ্নিত চক্র। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের মনিটরিং না থাকায় বেপরোয়া মিলার চক্র।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ি, বাবুবাজার,কাপ্তান বাজার, মোহাম্মদপুর বাজার, কারওয়ান বাজার, নিউমার্কেট বাজার, হাতিরপুল বাজারসহ কয়েকটি বাজারে গিয়ে ও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে মোটা চালের পাইকারি বাজারে দাম বেড়েছে বস্তা প্রতি ১৫০ টাকা থেকে ১৬০ টাকা। আর খুচরা বাজারে দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৫ টাকা। নাজিরশাইল, মিনিকেট, বিআর আটাশসহ সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা পর্যন্ত। সে হিসেবে প্রায় সব চালের দাম বস্তাপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়েছে।
চলতি সপ্তাহে বাজারে মিনিকেট চাল মানভেদে কেজিপ্রতি ৫৩ থেকে ৫৬ টাকা, বিআর আটাশ ৪৪ থেকে ৪৬ টাকা, নাজিরশাইল ৪৭ থেকে ৫০, পাইজাম ৪৫ থেকে ৪৭, মোটা চাল ৩৯ থেকে ৪২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে পোলাও-এর চাল আগের মতই মানভেদে কেজিপ্রতি ৮৫ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এবং বিভিন্ন কোম্পানির প্যাকেট পোলাও চালের দাম কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ক্রেতাদের অভিযোগ, বেশি মুনাফার আশায় দোকানিরা চালের দাম বাড়িয়েছেন। তবে বিক্রেতারা ক্রেতাদের অভিযোগ মানতে নারাজ। তাদের উল্টো অভিযোগ মিল মালিকদের উপর। এ বিষয়ে যাত্রাবাড়ি পাইকারি বাজারের চাল বিক্রেতা আনিস বলেন, মিল মালিকদের অবৈধ মজুদের কারণে দাম বেড়েছে চালের। আমরা বাড়াইনি। বেশি দামে কিনতে হচ্ছে তাই বেশি দামে বিক্রি করছি আমরা। দাম কেন বাড়তি জানতে হলে তাদের (মিল মালিক) ধরেন, সব পাইয়া যাবেন।
বাবুবাজারের নাজমা রাইস এজেন্সির মালিক কাউসার হোসাইন বলেন, অন্যান্য দ্রব্যের মতো চালের দামের ব্যাপারেও সরকারের নজরদারি করা উচিত। যেসব মিলার কারসাজি করে মোটা অংকের টাকা চালের বাজার থেকে হাতিয়ে নেয় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে চালের দাম আরো বাড়বে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চালের বাজারে কোনো সংকট না থাকলেও নিয়মিত দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। দাম বাড়াতে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী বিভিন্ন অজুহাত দেখাচ্ছেন। মিল মালিকরা বলছেন, ধান আসতে দেরি হচ্ছে। আর এ কারণেই ধানের দাম অনেক বেড়েছে। এতে চালের দাম কিছুটা বেশি। নতুন ধান এলে দাম অনেক কমে যাবে।
উত্তরের সর্ববৃহৎ চালের মোকাম নওগাঁয় মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রতি বস্তায় ১৫০ টাকা। আর চিকন চালের দাম বেড়েছে ১০০ টাকা। মিল মালিকরা বলছেন, ধানের দাম বাড়ার কারণেই এমন মূল্য বৃদ্ধি। তবে, খুচরা ব্যবসায়ীদের দাবি, মিলারদের সিন্ডিকেটের কারণেই এমন অবস্থা।
দেশের অন্যতম চালের মোকাম নওগাঁ। চাহিদার বেশীরভাগই যায় এ জেলা থেকে। কিন্তু গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে এখানেও বেড়েছে চালের দাম। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, চিকন চালের মধ্যে পাইজাম, জিরা ও নাজিরশাইলের দাম কেজিতে ২ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৬ থেকে ৪৮ টাকায়। তবে, সবচেয়ে দাম বেড়েছে মোটা চালের। স্বর্ণা-৫ জাতের মোটা চাল ৩৩ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩৮ টাকায়। আর এ দাম বাড়ায় মিলারদের দায়ী করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেন, বর্তমানে দেশে উৎপাদিত চালেই দেশের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। এই সময়টাতে চালের দাম বাড়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে উত্তরবঙ্গের চাল ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট সব ভেঙে দিতে হবে। বর্তমানে তারাই চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে দাম বাড়াচ্ছে। সরকারি পর্যায়ে বাজার মনিটরিং শুরু হলে চালসহ সব ধরনের পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
এদিকে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক দশকে পাঁচ ধরনের চালের বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সব ধরনের চালের দাম ১০ বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়েছে। ক্যাবের ওই পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মিনিকেট চালের দাম ২০০৬ সালে ছিল প্রতি কেজি ২৭ দশমিক ৯৫ টাকা। ২০১৬ সালে ওই চালের দাম হয় ৪৮ দশমিক ৩৪ টাকা। ২০০৬ সালে নাজিরশাইলের দাম ছিল ২৫ দশমিক ৫৪ টাকা। ২০১৬ সালে ওই চালের দাম হয় ৫৫ দশমিক ৭৮ টাকা। ২০০৬ সালে পাইজাম চালের দাম ছিল ২৩ টাকা। ২০১৬ সালে ওই চালের দাম দাঁড়ায় ৪০ দশমিক ৩৭ টাকা। ২০০৬ সালে পারিজা/স্বর্ণার দাম ছিল ১৯ দশমিক ২৫ টাকা। গত বছর ওই চালের দাম ছিল ৩৭ দশমিক ১৯ টাকা। ২০০৬ সালে বিআর ১১/৮ এর দাম ছিল ১৮ দশমিক ২৫ টাকা। গত বছর ওই চালের দাম দাঁড়ায় ৩৫ দশমিক ৪১ টাকা।
জানা গেছে, নি¤œ আয়ের মানুষদের জন্য সরকার ট্রাক সেল এবং জেলা উপজেলা পর্যায়ে রয়েছে ১০ টাকা দরে চাল। কিন্তু তাতে বাজারে চালের দামে কোন প্রভাব পড়ছে না। রাজধানীর ট্রাক সেলে চাল বিক্রি হয়ে থাকে ১৫ টাকায় আর আটা বিক্রি হয়ে থাকে ১৭ টাকায়। নি¤œ আয়ের কিছু মানুষ এ চাল সংগ্রাহ করে থাকলেও নি¤œ-মধ্য আয়ের মানুষরা তা কিনতে পারছে না। তাছাড়া এ চাল অনেক সময় গন্ধ ও পোকা পাওয়া যায়। যা কোনভাবেই খাওয়ার উপযোগী নয়। আর এ কারণেই বেশি দামে চাল কিনতে অনেকেই বাধ্য হয়ে থাকেন।
চাল নিয়ে কারসাজি নতুন নয়। কিন্তু সরকার কোনভাবেই এ সিন্ডিকেট ভাংতে পারছে না। সরকার একাধিকবার ব্যবস্থা নিতে চাইলেও সফল হয়নি। কারণ সরকার ব্যবস্থা নিতে চাইলেই তারা এক জোট হয়ে চাল বিক্রি বন্ধ করে দেয়।
চাল উৎপাদন ও সরবরাহে কোনো ঘাটতি না থাকলেও বাজারে দাম বৃদ্ধির অস্বাভাবিক ধারায় অসন্তুষ্ট ক্রেতারা। তাদের মত, কার্যকর নজরদারির অভাবেই একটি সাধু চক্র এর সুবিধা নিচ্ছে।
সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, মূলত সরকারের নজরদারি না থাকার কারণেই নিজেদের ইচ্ছামত বাড়তি দামে চাল বিক্রি করছে ব্যবসায়ীরা। কোন অজুহাত ছাড়াই বাড়ছে চালের দাম। এতে করে বিপাকে পড়ছে মধ্য আয়ের মানুষ।
জানা গেছে, গত বছরের আগস্ট থেকে দফায় দফায় চালের দাম বেড়েছে। মাঝপথে কিছুটা কমলেও এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে। গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে আমন ধানের চাল বাজারে এসেছে। কিন্তু দাম কমেনি।
ব্যবসায়ীরা জানান, আমনের বড় অংশই কৃষকের কাছ থেকে কিনে নিয়েছে ফড়িয়া ও মিলাররা। তারা এগুলো চাল করে বাজারে ছাড়ার কথা। কিন্তু তারা বাজারে না ছেড়ে নিজেদের আড়তে মজুদ রেখেছেন। ফলে বিভিন্ন মিলারের কাছ থেকে বাজারে নতুন চালের সরবরাহ আসছে না। এ কারণে বাজারে নতুন চালের সংকট দেখা দেয়ায় এভাবে দাম বেড়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, মিল মালিকরা চালের দাম বাড়ানোর ইচ্ছা করলেই চাল বিক্রি বন্ধ করে তা মজুদ রাখেন। এতে করে বাজারে চাহিদা বেড়ে যায় এবং সরবরাহ কমে যায়। ফলে কোন কারণ ছাড়াই চালের দাম বাড়িয়ে থাকেন পাইকারি আড়তদাররা। আর এর প্রভাব পড়তে থাকে খুচরা বাজারে।
এদিকে চালের দাম বাড়ার জন্য খুচরা, পাইকারি ও মিলাররা একে অপরকে দায়ী করছেন। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বাজারে চালের দাম বাড়ার কারণে তারাও বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। আবার পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল মালিকরা চালের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন, একই সঙ্গে দামও বাড়িয়েছেন। ফলে তাদের কাছ থেকে বেশি দামে চাল কেনার কারণে বাজারেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
টিসিবি বলছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে তারা নিয়মিত ট্রাক সেল করছে। আর ট্রাকের চালের দাম আগের চেয়ে অনেক কমেছে। আগের মোটা চাল বিক্রি হতো ২৩ টাকায়। এখনও তা বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকায়। চালের মান ভাল হলে গ্রাহক অনেক থাকেন আর মান খারাপ হলে গ্রাহক কমে যায়। তবে বাজারে তেমন কোন প্রভাব নেই।

 

http://www.dailysangram.com/post/278398-