১ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১০:২৮

জনমনে আতঙ্ক

বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ সারাদেশে খুন গুমের ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বাসা থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর কয়েক ঘন্টার মধ্যে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতা নুরুল আলম নুরুর মাথায় গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে। ডিবি পরিচয়ে এক ব্যবসায়ীসহ তিনজনকে তুলে নেওয়ার ৮দিন পরেও তাদের কোন সন্ধান মিলেনি। ঢাকার কলাবাগানে দিনে দুপুরে ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কিছুদিন আগে কসবায় পুলিশের গুলিতে জহিরুল ইসলাম নামের একজন নিহত হয়েছে। এসব পরিবারে চলছে আহাজারী। হঠাৎ করে এমন গুম-খুনের ঘটনায় সর্বত্র উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। 

ছাত্রদল নেতা নুরুর পরিবারের সুস্পষ্ট অভিযোগ রাউজানের নোয়াপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এস আই জাবেদের নেতৃত্বে একদল পুলিশ নুরুকে নগরীর বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছে। তবে পুলিশ এসব অভিযোগ অস্বীকার করছে। অন্যদিকে গুম হওয়া তিনজনের পরিবারের অভিযোগ তাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে। তুলে নেওয়ার একদিন পর তাদের একজন ফোনে জানিয়েছে যারা আমাদের তুলে নিয়ে এসেছে তারা ‘সরকারের বিশেষ বাহিনীর লোক’।
তবে চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন তারা এবিষয়ে কিছুই জানে না। এতে করে ওই তিনজনের পরিবার অজানা এক আতঙ্কে দিনযাপন করছে। নিখোঁজ তিনজনের পরিবারের আকুতি ‘তাদের জীবিত ফিরিয়ে দিন’। বিগত কয়েক বছরে চট্টগ্রামে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে হত্যা এবং গ্রেফতারের পর ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারে’ একাধিক হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। নদী-খালে মিলছে অজ্ঞাত লাশ। পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় গুপ্ত খুনের এসব ঘটনা কুলকিনারা হচ্ছে না। খুনীরা থেকে যাচ্ছে আড়ালে। হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে বিএনপি ছাত্রদল ও বিশ দলের শরিক দলের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীও। অনেকে জীবনের তরে পঙ্গু হয়েছে। বিরোধী দলের আন্দোলনের সময়ও অনেককে তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। ফের হঠাৎ করে গুম খুনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সর্বত্রই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
বুধবার রাতে চট্টগ্রাম নগরীর বাসা থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পরদিন সকালে হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নুরুর লাশ পাওয়া যায়। পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ পুলিশ তাকে তার চন্দনপুরার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। নুরুর ভাগ্নে রাশিদুল ইসলাম জানান, তার সামনেই নোয়াপাড়া ফাঁড়ির ইনচার্জ এস আই জাবেদসহ একদল পুলিশ বাসায় হানা দিয়ে নুরুকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যায়। পরদিন রাউজান উপজেলার বাগোয়ান এলাকায় কর্ণফুলী নদীর পাড়ে নুরুর লাশটি পাওয়ার কথা পুলিশ জানায়।
তবে সকালে স্থানীয়রা নদীর পাড়ে হাতে রশি ও চোখে কালো কাপড় বাঁধা লাশটি নদীর কাদায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখেন। পরে নিহতের স্বজনরা সেখানে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন। গতকাল চমেক হাসপাতালের মর্গে তার লাশের ময়না তদন্ত হয়। সুরতহাল রিপোর্টকারী পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন তার মাথায় দুটি গুলি করা হয়। এতে তার মাথা থেতলে যায়। চোখ ছিলো কালো কাপড়ে বাঁধা, মুখে কাপড়ের পুটলি ঢুকানো ছিল। শরীরজুড়ে ছিল প্রচন্ড আঘাতের চিহ্ন।
ঘটনাস্থলে যারা গেছেন তাদের ধারণা সেখানে নিয়ে নুরুর হাত-পা ও চোখ বাঁধা অবস্থায় তাকে বেদম প্রহার করা হয়। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করতে মাথায় গুলি করা হয়। স্থানীয়রা জানায়, নুরুর নিজ গ্রামের বাড়ি থেকে আনুমানিক ৫ কিলোমিটার দূরে কর্ণফুলী নদীর তীরে লাশ যাওয়া হয়। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, রাজনৈতিক কারণে নুরুকে পুলিশ তুলে নিয়ে হত্যা করেছে। এটি একটি লোমহর্ষক হত্যাকান্ড। নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার নুরু দুই সন্তানের জনক। তার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
নুরুকে তুলে নিয়ে হত্যার অভিযোগ প্রসঙ্গে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) রেজাউল মাসুদ ইনকিলাবকে বলেন, এধরনের অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই। কারণ, ওই রাতে পুলিশ নগরীতে কোন অভিযান পরিচালনা করেনি। ছাত্রদল নেতার লাশ উদ্ধার ও এ ধরনের অভিযোগ আসার পর পুলিশ সুপার এবিষয়ে খোঁজ খবর নিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, কাউকে ধরে আনলে এটা অবশ্যই ঊর্ধ্বতন অফিসাররা জানতেন। পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হলে হত্যা মামলাটি গুরুত্বের সাথে পুলিশ তদন্ত করে খুনীদের চিহ্নিত করবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে আট দিন আগে ডিবি (গোয়েন্দা বিভাগ) পরিচয়ে তিনজনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনারও কোন কিনারা হয়নি। তারা কোথায় আছে, কেমন আছে তা জানে না পরিবারের সদস্যরা। স্বজনের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। এ তিনজন হলেন, পরিবহন ব্যবসায়ী এস এম শফিকুর রহমান এবং তার দুই শ্যালক মো. হাসান তারেক ও মোয়াজ্জেম হোসেন সাথী। শফিকের বাসা নগরীর খুলশি থানার আলফালাহ গলিতে। তিনি নগরীর সল্টগোলা ঈশান মিস্ত্রি হাট এলাকার এস এস ট্রান্সপোর্টের মালিক। তারেকের বায়েজিদ এলাকায় টি আর মোবাইল টেকনোলজি নামে একটি দোকান আছে। তার ভাই মোয়াজ্জেম মধ্যপ্রাচ্য থেকে সম্প্রতি দেশে এসেছেন।
শফিকুরের স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া টুম্পা গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, তাদের তুলে নেওয়ার আট দিন পার হলেও তাদের কোন খোঁজ মিলছে না। তিনি বলেন, তুলে নেওয়ার একদিন পর শফিক বাসায় ফোন করে জানায় তারা যাদের তুলে নিয়ে গেছে তারা সরকারের বিশেষ বাহিনীর লোক। সেখানে তারা কঠিন সময় পার করছে উল্লেখ করে তাদের যেভাবে হোক ছাড়িয়ে নেওয়ার আকুতি জানান। টুম্পা বলেন, তাদের যদি কোন অপরাধীরা অপহরণ করতে তা হলে অবশ্যই মুক্তিপণ দাবি করতো। তার ধারণা তাদের যারা নিয়ে গেছে তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। তিনি বলেন, তাদের বিরুদ্ধে যদি কোন অভিযোগ থাকে তাদের আদালতে হাজির করা হোক। তিনি তার স্বামী ও দুই ভাইকে জীবিত ফেরত চেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
শফিককে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তার একমাত্র পুত্র মো. ইসমাইল নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। সারা দিন সে বাবার জন্য কাঁদছে। তার আকুতি আমার বাবাকে ফিরিয়ে দাও, আমি তার হাত ধরে স্কুলে যাব। শিশুর কান্নায় বাড়ির পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে। কাঁদছে স্বজন-প্রতিবেশীরাও। একই দৃশ্য হাসান হোসেনের বাড়িতেও। হাসানের স্ত্রী ফৌজিয়া আইনুন নাহার রুমি সন্তান সম্ভবা, বোন এইচ এস সি পরীক্ষার্থী। দুই ভাইকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তাদের পরিবারের আহাজারি থামছে না।
টুম্পা জানান, ২৪ মার্চ দুপুরে ৬ জন লোক নিজেদের ডিবি পরিচয় দিয়ে তাদের আলফালাহ গলির বাসায় আসে। ঘরে ঢুকেই তারা তিনজনের আটটি মোবাইল কেড়ে নেয়। এরপর তারা আমার স্বামী ও ভাই মোয়াজ্জেমকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। অপর ভাই তারেক মোটর সাইকেল নিয়ে মাইক্রোবাসের পেছনে পেছনে যেতে থাকলে পাঁচলাইশ থানার সামনে থেকে তাকেও মোটর সাইকেলসহ তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
টুম্পা বলেন, ২৫ মার্চ খুলশি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। পুলিশ এসে আমাদের সবার বক্তব্য নিয়েছে। কিন্তু এরপর থানা আর কোন যোগাযোগ করেনি। তুলে নেওয়ার পর শফিকুর তার মোবাইল থেকে স্ত্রীর মোবাইলে ফোন করে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমাদের যারা তুলে নিয়ে এসেছে তারা নাকি সরকারের বিশেষ টিমের লোকজন। আমার এখানে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাদের উপর অমানবিক ও পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। আমাদের এখান থেকে উদ্ধারের ব্যবস্থা কর।
এবিষয়ে খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন বলেন, ওই তিনজনকে তুলে নেওয়ার পর থানায় একটি জিডি করে তাদের পরিবার। আমরা এবিষয়ে খোঁজ খবর নিয়েছি, তবে কারা তাদের তুলে নিয়ে গেছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ডিবি পুলিশও তাদের নিয়ে যায়নি বলে আমাদের নিশ্চিত করেছে।
এদিকে গত ৩০ মার্চ রাজধানীর কলাবাগানে দিনে দুপুরে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। গত ১৮ মার্চ কসবায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে জহিরুল ইসলাম নামের একজন। ওই দিন রায়পুরায় স্কুলছাত্রীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়।
চবি ছাত্র রনি কোথায়?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ’র (ব্যবস্থাপনা) ছাত্র তারিকুল ইসলাম রনি কোথায়- এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি পাঁচদিনেও। গত ২৫ মার্চ নগরীর মুরাদপুর থেকে কয়েকজন তাকে তুলে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় রনির এক আত্মীয় বাদী হয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। পরে পুলিশ দুজনকে আটক করে। এখনও তাকে উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। তার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কেও কিছুই জানে না পুলিশ। জামালপুর জেলার শাহবাজপুর গ্রামের কৃষক মো. আবুল হোসেনের পুত্র রনি। তাকে তুলে নেয়ার খবরে অসুস্থ হয়ে পড়েন মা জরিনা বেগম।
রনির বড় ভাই আনোয়ার হোসাইন সাংবাদিকদের জানান, রনি অনেক ভালো ছেলে। কারও সঙ্গে তার ঝামেলা বা শত্রæতা থাকার কথা নয়। কারণ সে কোনো ঝামেলায় জড়ায় না। পুলিশকে আমরা অভিযোগ দিয়েছি কিন্তু পুলিশ শুধু দেখছে বলেই সান্ত¦না দিচ্ছে। পাঁচদিন পার হয়ে গেলেও এখনও কোনো খোঁজ পাচ্ছি না আমার ভাইয়ের। পাঁচলাইশ থানার ওসি মহিউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আমরা দুজনকে ইতিমধ্যে আটক করেছি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। খুব শিগগরই রনিকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে।

https://www.dailyinqilab.com/article/72526/