৩০ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৫০

ঐতিহাসিক ব্রেক্সিট শুরু

যুগসন্ধিক্ষণে বৃটেন। শুরু হয়ে গেল ব্রেক্সিটের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া। গতকাল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) কাছে বৃটেনের ‘ডিভোর্স পেপার’ পাঠিয়ে দিয়েছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। ব্রাসেলসে ইউরো-পিয়ান কাউন্সিলের প্রধান ডনাল্ড টাস্কের হাতে ৬ পৃষ্ঠার পত্রটি তুলে দেন ইইউতে নিযুক্ত বৃটেনের স্থায়ী প্রতিনিধি স্যার টিম ব্যারো। এর কয়েক মিনিট পরই হাউস অব কমন্সে ইইউ জোটের মূল সনদ লিসবন চুক্তির অনুচ্ছেদ ৫০ সক্রিয় করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। তার সঙ্গে সঙ্গেই যেন শেষের শুরুর ঘণ্টা বাজলো। অনুচ্ছেদ-৫০ সক্রিয় করায় নিয়ম মোতাবেক ২ বছরের ‘কাউন্টডাউন’ শুরু হয়ে গেছে। এ ২ বছরের মধ্যেই দু’পক্ষকে আলোচনা-সমঝোতার মাধ্যমে ঠিক করতে হবে তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের রূপরেখা কী হবে। কিন্তু দু’পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারলে, কোনো চুক্তি ছাড়াই শেষ হবে সমঝোতা। আর সেক্ষেত্রে বৃটেনের সঙ্গে ইইউভুক্ত দেশগুলোর সম্পর্ক হবে অন্য আর দশটি দেশের মতোই। অবশ্য বৃটেন ও ইইউ’র সকল সদস্য রাষ্ট্রের সম্মতিতে আলোচনার সময় বাড়ানো যাবে। তবে নিজেদের পত্রে চুক্তিতে উপনীত না হতে পারার পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে বৃটেন।

প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে পার্লামেন্টে বলেছেন, ‘আজ সরকার বৃটিশ জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিচ্ছে। এটা ঐতিহাসিক এক মুহূর্ত যেখান থেকে ফেরত আসার কোনো সুযোগ নেই। ইইউ ছাড়ছে বৃটেন।’ ইইউতে থাকা বা প্রস্থানের প্রশ্নে অনুষ্ঠিত তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ গণভোটে বৃটিশ জনগণ প্রস্থানের পক্ষেই মত দেয়। গণভোটের নয় মাস পর ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হলো। তার কণ্ঠে ছিল আশাবাদের সুর। তিনি বলেন, ‘আমি এটা বিশ্বাস করি বৃটেনে আমাদের সেরা দিনগুলো সামনে অপেক্ষা করছে।’
প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে কমন্সে ব্রেক্সিটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়ার পরপরই বক্তব্য রাখেন লেবার নেতা জেরেমি করবিন। এতে তিনি সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন, ব্রেক্সিট নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মে’র পরিকল্পনা ‘বেপরোয়া ও ক্ষতিকর’। আর তার দল ব্রেক্সিট ব্যবহার করে শ্রমিক অধিকার খর্ব করার সুযোগ প্রধানমন্ত্রীকে দেবে না। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেন, শুধু ‘নিজেদের শিবিরের কট্টর টোরি ভাবাদর্শ’ শুনলে হবে না। যুক্তরাজ্য যেন কর এড়ানো লোকজনের স্বর্গরাজ্য না হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখার আহ্বান জানান করবিন। তিনি আরো বলেন, তেরেসা মে’কে অবশ্যই আলোচনা করতে হবে এবং পুরো দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রধান ডনাল্ড টাস্ক চিঠি পাওয়ার পর বৃটেনের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে তোমাকে মিস করতে শুরু করেছি।’ সিএনএন’র খবরে বলা হয়, বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া তিক্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ইইউ নেতারা জোটটি ছাড়ার পথ সহজ রাখতে রাজি নন। কারণ, শঙ্কা রয়েছে অন্যান্য দেশও হয়তো একই পথ ধরতে পারে। ইইউ নেতারা এ নিয়ে কোনো রাখঢাক রাখেননি যে, ব্রেক্সিটে তারা খুশি নন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ গতকালও প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, আমি মনে করি বৃটিশ জনগণের জন্য এ বিচ্ছেদ যন্ত্রণাদায়ক হবে। ব্রেক্সিট ইউরোপকে সামনে অগ্রসর হতে বাধ্য করবে, নিঃসন্দেহে ভিন্ন গতিতে। অবশ্য চিঠি পাওয়ার পর ডনাল্ড টাস্কের কণ্ঠ যেন ছিল বিষাদমাখা। আসন্ন বিচ্ছেদের কথা ভেবে বিপর্যস্ত বরের মতো। তিনি বলেন, ‘এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, এটি একটি আনন্দময় দিন। ব্রাসেলসেও নয়, নয় লন্ডনেও। হাজার হলেও, বেশিরভাগ ইউরোপিয়ান ও বৃটিশ ভোটারদের প্রায় অর্ধেকের ইচ্ছা হলো আমরা একসঙ্গে থাকি, আলাদা নয়।’ তার কণ্ঠে তবে ইতিবাচকতাও ছিল। বললেন, ব্রেক্সিট জোটের অবশিষ্ট ২৭টি সদস্যকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে আরো অঙ্গীকারবদ্ধ করেছে। তার ভাষ্য, ‘আর কী বলার আছে আমার? আমরা তোমাকে ইতিমধ্যে মিস করছি।’
ইউরোপিয়ান কাউন্সিল নিজেদের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলেছে, আমরা দুঃখবোধ করছি যে যুক্তরাজ্য ইইউ ছেড়ে যাবে তবে আমরা এ প্রক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হবে যুক্তরাজ্যের ইইউ ত্যাগের সিদ্ধান্তের ফলে আমাদের নাগরিক, ব্যবসাসমূহ এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সৃষ্টি অনিশ্চয়তাকে লাঘব করা। বিবৃতির শেষে বলা হয়, আমরা যুক্তরাজ্যকে ঘনিষ্ঠ এক অংশীদার হিসেবে পাওয়ার প্রত্যাশা রাখি।
অনুচ্ছেদ ৫০ সক্রিয় করায় প্রধানমন্ত্রী মে’র সরকার ও ইইউ’র মধ্যে ২ বছরের আলোচনার সময় গণনা শুরু হয়েছে। এ আলোচনার লক্ষ্য বাণিজ্য, অভিবাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সহ বহু বিষয়ে দু’ পক্ষের চুক্তি। হাউস অব কমন্সে নিজের বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী মে বলেছেন, তিনি এ আলোচনায় যুক্তরাজ্যের সব অংশের স্বার্থ দেখবেন। তিনি বৃটেনে বসবাসরত ইইউ নাগরিকদের অধিকার অগ্রাধিকারভিত্তিতে সুরক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেন। জার্মান চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেলও ইইউ নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বৃটেনের সঙ্গে আলোচনায় এটি নিশ্চিত করা হবে জার্মানির লক্ষ্য।
কিন্তু ইইউ থেকে তিক্তভাবে প্রস্থান বৃটেনের জন্য কেমন হবে, তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। খোদ প্রধানমন্ত্রীও ইইউ ছাড়ার কিছু নেতিবাচক পরিণতির কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, আমরা ইউরোপিয়ান অর্থনীতির নিয়মকানুনের ওপর প্রভাব হারাবো। বৃটিশ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ওইসব নিয়ম কানুন মানতে হবে যা প্রণয়নে যুক্তরাজ্যের হাত থাকবে না। তবে বৃটিশ সরকার সেটা মেনে নিয়েছে। ইইউ’র সঙ্গে সহযোগিতা দুর্বল করাটা ‘ব্যয়বহুল ভুল’ হবে বলে তিনি সতর্কবার্তা দেন।
অপরদিকে বৃটেনের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার হলো ইইউ। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, দুই বছরের মধ্যে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করতে পারার সম্ভাবনা কম। সিএনএন’র রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক রবিন ওকলি বলেন, কানাডা ও ইইউ গত ৭ বছর ধরে একটি বাণিজ্য চুক্তি করতে আলোচনা করে যাচ্ছে। দুই পক্ষই রাজি, এরপরও এত বছর লাগলো। তাই সহজেই বাণিজ্য চুক্তি সম্ভব নয় বলেই তার ধারণা। তিনি আরো বলেন, ‘এই আলোচনা বেশ বিরক্তিকর হবে। মাঝেমধ্যে হতাশাজনক আর মন অসাড় করে দেয়ার মতো জটিল হয়ে উঠতে পারে।’
এদিকে শুধু ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নয়, ব্রেক্সিটের জেরে ভাঙনের হুমকিতে পড়েছে যুক্তরাজ্যও। স্কটিশ পার্লামেন্ট বুধবার ফের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট আয়োজনের পক্ষে মত দিয়েছে। স্কটল্যান্ড ব্রেক্সিট-গণভোটে ইইউতে রয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিল। তাই যুক্তরাজ্য শেষ পর্যন্ত কড়াভাবে ইইউ প্রস্থানের পক্ষে যাওয়ায় স্কটল্যান্ডের শাসক দল খোদ যুক্তরাজ্য থেকেই বের হয়ে যেতে চাচ্ছে। বুধবার অনুচ্ছেদ ৫০ সক্রিয় করার প্রেক্ষিতে আগাম প্রতিক্রিয়ায় স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টার্জন বলেন, ‘আজ প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাজ্যকে পর্বতের সুউচ্চ প্রান্তে নিয়ে যাবেন, অথচ অবতরণ করবেন কোথায় তার কোনো ধারণাই নেই। স্কটল্যান্ড এ জন্য ভোট দেয়নি। আমাদের মত উপেক্ষিত হয়েছে।’ ওদিকে উত্তর আয়ারল্যান্ডের নির্বাহী ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা। ওই আলোচনা ব্যর্থ হলে, উত্তর আয়ারল্যান্ড সরাসরি শাসিত হবে যুক্তরাজ্যের অধীনে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড নিয়ে বলেছেন, ‘আমরা আমাদের নিজেদের আইনের নিয়ন্ত্রণ নেবো। ইইউ ছাড়ার অর্থ হলো আমাদের আইন প্রণয়ন হবে ওয়েস্টমিনস্টার, এডিনবার্গ, কার্ডিফ ও বেলফাস্টে। আমরা আমাদের চার রাষ্ট্রের বন্ধনকে আরো শক্তিশালী করবো।’ তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, যুক্তরাজ্যের বাকি তিন দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষমতা খর্ব করা হবে না। আর যুক্তরাজ্যের চার দেশ একসঙ্গে ব্রেক্সিটের সমঝোতা করবে। ওয়েলসের লেবার দলের নেতা বলেছেন, তার ধারণা ব্রেক্সিটের ফলে ইংরেজ জাতীয়তাবাদ তুঙ্গে উঠবে। এদিকে অনুচ্ছেদ ৫০ সক্রিয় করার ঘোষণার পর ডলারের বিপরীতে বৃটিশ মুদ্রা পাউন্ড স্টার্লিং-এর দরপতন হয়েছে।

 

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=59474&cat=2/