২৯ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ৮:১০

মিটারে চলছে না সিএনজি

চালকদের সুবিধার্থে ৬০ ভাগ ভাড়া বৃদ্ধির পরও মিটারে চলছে না রাজধানীর সিএনজি অটোরিকশা। মিটার বাধ্যতামূলক করার নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আগের মতোই চুক্তিতে বা চালকের ইচ্ছায় চলছে সিএনজি। বেপরোয়া চালকদের ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চরমে পৌঁছেছে। ৪০ টাকার ভাড়া হাঁকাচ্ছে ২০০ টাকা। দূরের যাত্রায়ও মিটারে না গিয়ে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দাবি করছে চালকরা। যাত্রীদের অভিযোগ চালকরা অনেকটা জিম্মি করেই বেশি ভাড়া আদায় করছে। রাস্তায় গণপরিবহন কম থাকায় সিএনজি ও ট্যাক্সিতে যাতায়াত করে অধিকাংশ মানুষ। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোনো চালকই কম ভাড়ায় যেতে চায় না। রামপুরার বাসিন্দা মাহফুজুর রহমান নামের এক সিএনজির যাত্রী মানবজমিনকে বলেন, রামপুরা ব্রিজ থেকে কাওরান বাজার পর্যন্ত নতুন মিটার চার্জ অনুসারে সিএনজির ভাড়া আসে ৮৫ থেকে ১০০ টাকা। রাস্তা ফাঁকা থাকলে আরো কম টাকায় চলে আসা যায়। অথচ রামপুরা ব্রিজ থেকে কাওরান বাজার পর্যন্ত কোনো সিএনজি চালক ২০০ টাকার নিচে আসতে চায় না। মুক্তা খাতুন নামের অপর এক যাত্রী বলেন, কাওরান বাজার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে সিএনজি চালকরা ২০০ টাকা দাবি করে। বাসের ৫ টাকার ভাড়া কিভাবে ২০০ টাকা দাবি করে মাথায় আসে না। শামীম হোসেন নামের অপর এক যাত্রী বলেন, কোনো চালকই মিটারে যেতে রাজি হয় না। দুই একজন মিটারের চেয়ে ২০/৩০ টাকা বেশি দাবি করে। তবে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে চায় না। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা জাহিদ আহসান বলেন, অধিকাংশ অটোরিকশায় মিটারের কথা জিজ্ঞেস করলেই বলে আমার মিটার নষ্ট। সানজানা খাতুন নামের এক যাত্রী বলেন, দিনের বেলায় কিছু সিএনজি মিটারে যেতে চায়। কিন্তু বলে নেয় মিটারের চেয়ে কিছু টাকা বেশি দিতে হবে। তবে সন্ধ্যার পর আর কেউ মিটারে যেতে চায় না। ভাড়াও অনেক বেশি চায়। শামছুজ্জামান নামের এক যাত্রী বলেন, নিয়মিত আমি বাসাবো কদমতলা থেকে সিএনজি নিয়ে পান্থপথে যাতায়াত করি। মিটারে নতুন ভাড়া সংযুক্ত হওয়ার পর চালকরা মিটারের থেকে কিছু ভাড়া বাড়িয়ে দিতে বলতো। কিন্তু এখন কদমতলা থেকে ২৫০ টাকার কমে কোনো সিএনজি আসতে চায় না। যখন মিটারের চেয়ে ৩০ টাকা বেশি দিয়ে আসতাম, তখনও ভাড়া লাগতো ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। এখন দিতে হয় ২৫০ টাকা। নুসরাত জাহান নামের এক যাত্রী বলেন, আমাকে উত্তরা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হয়। এতে সিএনজি ভাড়া করলে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা ভাড়া দেয়া লাগে। কোনো চালকই মিটারে যেতে রাজি হয় না।
মাসুদুর রহমান নামের এক যাত্রী বলেন, গাবতলী থেকে কুড়িল বিশ্বরোড যেতে সিএনজি খুঁজতে যান তিনি। কিন্তু কোনো চালকই মিটারে যেতে রাজি হয়নি। সবাই চুক্তিতে যেতে আগ্রহী। কোনো কোনো চালক গাবতলী থেকে বিশ্বরোডের ভাড়া হেঁকেছেন ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। আজিজুল হক নামের এক যাত্রী আক্ষেপ করে বলেন, কোথাও সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। মিটারে চলতে হবে বলে ভাড়া বাড়ানো হলো। কিছুদিন চললোও সেভাবে। কিন্তু এখন আর কেউ তা মানছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চালক ও মালিকদের দাবি মেনে সরকার ১লা নভেম্বর থেকে রাজধানী ঢাকার যাত্রী ভাড়া বাড়িয়েছে গড়ে ৬০ ভাগ। নতুন নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী প্রথম দুই কিলোমিটার ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে আগের ২৫ টাকার বদলে ৪০ টাকা। মালিকদের জমার পরিমাণও বাড়িয়ে ৬০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা করা হয়েছে। প্রথম দুই কিলোমিটারের পর প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ৭ টাকা ৬৫ পয়সা থেকে বৃদ্ধি করে ১২ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া, বিরতিকালের জন্য ভাড়ার হার প্রতি মিনিটে ১ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ২ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। যে কোনো দূরত্বে যাত্রী পরিবহনে বাধ্যতামূলক সর্বনিম্ন ভাড়া ৪০ টাকা। রাজধানীতে ১৩ হাজার সিএনজি অটো আছে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র ৬ হাজার অটোরিকশাতে নতুন মিটার সংযোজন করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, নতুন ভাড়া কার্যকরের আগে সব সিএনজি চালিত অটোরিকশার মিটারে নতুন ভাড়ার সফটওয়্যার বসাতে হয়।
সিএনজি চালকদের দাবি, মালিকদের জমা অঙ্ক ও গ্যাসের দাম বেড়েছে তাই বেশি ভাড়া নিতে হচ্ছে। হাবিবুর রহমান নামের এক সিএনজি চালক মানবজমিনকে বলেন, সরকার মিটারে চলতে বলেছে। কিন্তু ভাড়া বাড়ানোর কারণে মালিকরা আগের চেয়ে বেশি জমা চাচ্ছেন। এছাড়া গ্যাসের দামও আগের চেয়ে বেড়েছে। তাই আগের মতো ভাড়ায় চালানো সম্ভব হচ্ছে না। অপর সিএনজি চালক মো. সবুজ মিয়া বলেন, পুলিশকে প্রতি সিএনজি অটোরিকশা মাসে ৫ হাজার টাকা করে দেয়। এই জন্য পুলিশ কিছু বলে না। তবে সিএনজির চালক (ঢাকা মেট্রো-থ ১৪০২৬৮) মো. হোসেন দাবি করেন, প্রাইভেট গাড়ির মিটার লাগে না। মিটার ছাড়াই সব প্রাইভেট গাড়ি চলছে। একই কথা বলেন, (ঢাকা-মেট্রো-থ-১২৮৯৪২) গাড়ির চালক মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, আমরা এভাবেই চলছি। আমাদের পুলিশ কিছু বলে না।
রাজধানীর সদরঘাট, গুলিস্তান, প্রেস ক্লাব, পল্টন, কাকরাইল, দৈনিক বাংলা, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, বাসাবো, মুগদা, খিলগাঁও চৌরাস্তা, ফকিরাপুল, ফার্মগেইট, মালিবাগ, মিরপুর-১০, ধানমন্ডি, এলিফ্যান্ট রোড, শাহবাগ, বিমানবন্দর, মহাখালী এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, চালকরা মিটারে যেতে অনিচ্ছুক। আবার অধিকাংশ সিএনজি অটোরিকশার মিটারই নষ্ট। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় ঢাকা মেট্রো-থ ১৪-৩৬৮৭ নম্বরের একটি অটোরিকশার ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলে বলেন, মিটার আছে। কিন্তু ভেতর থেকে ওই সিএনজির যাত্রী তাহের আলী বলেন, ওর মিটার নষ্ট। আর অন্য সিএনজি যেতে রাজি হচ্ছে না বলেই বাধ্য হয়ে তাকে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েই যাচ্ছি। একইভাবে কবির হোসেন নামের শাহবাগগামী এক যাত্রী ঢাকা মেট্রো থ-১৩-৩৪১০ নম্বরের সিএনজিতে ২০০ টাকা ভাড়ার চুক্তি করে উঠেছেন। তবে তাকে আগে থেকেই বলা হয়েছে, রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ বা মোবাইল কোর্ট ধরলে মিটারে যাচ্ছে বলতে হবে। নইলে তাকে নেয়া হবে না।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকা মহানগরীতে চলাচলরত অটোরিকশার ৬২ ভাগ চুক্তিতে চলাচল করে। মিটারে চলাচলকারী অটোরিকশার ৮১ শতাংশ ২০ টাকা থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বকশিশ দাবি করে। যাত্রীদের চাহিদার গন্তব্যে যেতে রাজি হয় না ৭৩ ভাগ অটোরিকশা। এছাড়া, প্রাইভেট সিএনজি ভাড়ায় যাত্রী বহন এবং ঢাকা জেলার অটোরিকশা বেআইনিভাবে ঢাকা মহানগর এলাকায় প্রবেশ করে ৩৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, মিটারের মাধ্যমে ভাড়া নেয়ার বিষয়টিকে তোয়াক্কাই করছেন না অটোরিকশার চালকরা। ভাড়া নিয়ে তাদের স্বেচ্ছাচারিতা চলছেই। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষেরও কোনো তৎপরতা নেই। যাত্রীদের অভিযোগ, চালকদের অনিয়মের বিরুদ্ধে বিআরটিএ এবং পুলিশ অভিযান চালায় বলে প্রচার করে কিন্তু এটা দৃশ্যমান নয়। বিআরটিএ যদি ব্যবস্থা নেয়, তাহলে অটোরিকশার চালকেরা কেন নিয়ম অনুযায়ী ভাড়া নিচ্ছেন না।
তবে বিআরটিএ’র সচিব মুহাম্মাদ শওকত আলী মানবজমিনকে জানান, সিএনজিগুলো যেকোনো দূরত্বে, যেকোনো গন্তব্যে মিটারে যেতে বাধ্য। যদি না যায়, তবে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ, বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত অথবা দায়িত্বরত ট্রাফিককে জানালে সেই চালকের বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এছাড়া, কেউ চাইলে বিআরটিএ কার্যালয়ে গিয়ে লিখিতভাবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগও দাখিল করতে পারে। তিনি বলেন, মিটারে না যাওয়া ও নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে না চাওয়াসহ বিভিন্ন অপরাধে বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন এলাকা থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ধরে জরিমানা, চালককে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডসহ তাৎক্ষণিক ডাম্পিংয়ে পাঠিয়ে থাকেন।
বিআরটিএ’র পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) নাজমুল আহসান মজুমদার বলেন, প্রতিটি যানবাহনের অনিয়ম ধরার জন্য আমাদের ৬টি ভ্রাম্যমাণ আদালত রয়েছে। প্রতিদিনই রাজধানীর কোনো না কোনো এলাকায় আদালত পরিচালনা করছি।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=59323&cat=10/