২৮ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:৫৩

হতাশার কালো মেঘ ট্যানারি পল্লীজুড়ে

সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে যেকোনো সময়; রফতানি প্রবৃদ্ধি নিয়ে আতঙ্কিত সংশ্লিষ্টরা; কর্মব্যস্ততা থাকলেও কারো মুখে হাসি নেই

শ্রমিক-কর্মচারীদের পদচারণা, মেশিনের শব্দ আর নালাভর্তি রঙিন পানির গতিবেগÑ সবই আছে হাজারীবাগের ট্যানারি পল্লীতে। আবার মেশিনারি স্থানান্তর, মূল্যবান দ্রব্যাদি সরানো এবং লেনদেনও চলছে কোনো কোনো কারখানায়। তবে কারো মুখেই হাসি নেই। নেই কর্মচাঞ্চল্য ও উৎসাহ-উদ্দীপনা। হতাশার কালো মেঘ যেন চেপে বসেছে সবার চোখেমুখে। চাপা আতঙ্ক আর ক্ষোভ বিরাজ করছে শ্রমিক-মালিক সবার মাঝে। কারণ, যেকোনো সময় বন্ধ হতে পারে বিদ্যুতের আলো। থেমে যেতে পারে পানির সরবরাহ। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, ট্যানারি পল্লীর পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন সব কিছু বিচ্ছিন্ন করে আগামী ৬ এপ্রিল আদালতে রিপোর্ট করতে হবে।
হাজারীবাগে গিয়ে আবুল খায়ের ট্যানারি, মিল্লাত, স্বদেশ, ক্রিসেন্ট, আল-আমীন, প্রগতি, এমএস, সারোয়ার, ইব্রাহিম ও বে-ট্যানারিসহ বেশ কয়েকটি কারখানা ঘুরে দেখা যায়Ñ দিনরাত কাজ চলছে। দম ফেলার সময় নেই এসব কারখানার মালিক-শ্রমিকদের। কারণ তাদের হাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ কাঁচা চামড়া, যেগুলোর প্রথমিক পরিচর্যা গ্যাস ছাড়া সম্ভব নয়। চালু কারখানাগুলোর কোনো কোনোটি সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে আংশিক স্থানান্তর হয়ে গেলেও সেখানে এখনো গ্যাস সংযোগ না থাকায় প্রসেসিং করা সম্ভব নয়। হাজারীবাগের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হলে এসব চামড়া নষ্ট হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এক দিকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশমতো বন্ধ করে দিতে হচ্ছে হাজারীবাগের সব ট্যানারি কারখানা। অন্য দিকে সাভারের ট্যানারি পল্লীতেও এখনো পুরোদমে কারখানা চালু করার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি। এ অবস্থায় রফতানিযোগ্য চামড়া প্রক্রিয়াকরণ এবং বিদেশী ক্রেতাদের সময়মতো পণ্য বুঝিয়ে দেয়া নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সৃষ্ট দুরবস্থার জন্য ট্যানারি মালিকেরাও কম দায়ী নন। কারণ হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরাতে তারা ১৪ বছর সময় পেয়েছেন। দীর্ঘ ১৪ বছর পেয়েও এখন ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরে টানাহেঁচড়া বেমানান বলে মনে করছেন পরিবেশবিদেরা। এ ক্ষেত্রে সরকারপরে অনেক ব্যর্থতা থাকলেও ট্যানারি মালিকদের গাফিলতিও কম নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, ট্যানারি স্থানান্তর নিয়ে দেশে আমরা যেমন চরম সঙ্কটে পড়েছি, ঠিক তেমনি সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে বিশ্ববাজারেও। ক্রেতারা প্রতিদিনই আমাদের কাছে ফোন বা ই-মেইলে জানতে চাচ্ছেন ট্যানারি স্থানান্তরের বিষয়ে। আমরা তাদের জানাচ্ছিÑ পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। কিন্তু তারা আমাদের কথায় ভরসা করে বসে না থেকে গণমাধ্যমের খবর ও এখানে থাকা তাদের এজেন্টের মাধ্যমে সঠিক তথ্য জানছেন।
ট্যানারি শিল্পের চলমান সঙ্কটের কারণে বায়াররা চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের নতুন রফতানি আদেশ কমিয়ে দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো কোনো ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে নতুন করে রফতানি আদেশ দেয়া বন্ধ করে ভারত, চীন বা অন্য কোনো দেশে দিচ্ছেন। কোনো ক্রেতা একবার আমাদের ছেড়ে অন্য কোনো বাজারে চলে গেলে তাকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না।
জানা যায়, শিল্প মন্ত্রণালয় সর্বশেষ ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল। পরে ট্যানারি মালিকেরা বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সাথে বৈঠক করে তাদের সমস্যার কথা জানালে তিনি জুন পর্যন্ত সর্বশেষ সময় দেয়ার ঘোষণা দেন। তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে হাজারীবাগের কারখানাগুলো বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরপর হাজারীবাগের সব সরঞ্জাম সাভারের ট্যানারি পল্লীতে নিয়ে পুনরায় কারখানা চালু করবেন অনেকে।
ট্যানারি মালিকেরা জানান, কারখানা বন্ধ রাখা ও রফতানি বন্ধ হওয়া ছাড়াও হাজারীবাগের প্রায় ৩০ হাজার ট্যানারি শ্রমিককে সামলানো তাদের জন্য আরেক সঙ্কট। কারণ বন্ধ ঘোষণা করলে বা লে-অফ করলে শ্রমিকেরা সেটা সহজে মেনে নেবেন না। ট্যানারি শ্রমিকদের সংগঠন ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের নেতারা ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, কারখানা লে-অফ বা বন্ধ ঘোষণা করলে তারা তা মানবেন না। কারণ এতে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক বেকার হবেন।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, হাজারীবাগে বর্তমানে দুই শতাধিক ট্যানারি রয়েছে। আর প্রত্যেক ট্যানারি মালিক কোনো না কোনো ব্যাংকের কাছে ঋণী। ব্যাংকে কোটি কোটি টাকার ঋণ রয়েছে ট্যানারি মালিকদের। সাধারণত কারখানা চালু থাকলে চামড়া বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণের দায়, শ্রমিক বেতন এবং নিজেদের মুনাফাসহ সব কিছুই সারেন ট্যানারি মালিকেরা। কারখানা বন্ধ থাকলে ব্যাংকের ঋণের কিস্তি দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এ েেত্র বেশির ভাগ ট্যানারি মালিকের ঋণখেলাপি হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান তারা।
তবে আশার দিক হলো, এতসব সমস্যার মধ্যেও চামড়া রফতানি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হয়েছে। বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্র“য়ারি) চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানির ল্যমাত্রা ছিল ছয় হাজার ৩৪৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ছয় হাজার ৬২০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। ল্যমাত্রার চেয়ে আয় বেশি হয়েছে ৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ, আর গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় বেড়েছে ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ গত মাস পর্যন্ত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানিতে বেশ ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হলে এ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কঠিন হবে বলে জানান এ খাতের উদ্যোক্তারা।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/207362