ক্যাপশন : সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মুহূর্তে আগুনে পুড়ে যায় সিএনজি চালিত অটোরিকশাটি। গত শনিবার কুমিল্লায়।
১৯ জানুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ১১:১০

গ্যাস সিলিন্ডারে মৃত্যুফাঁদ

দেশে সিএনজি গ্যাস সিলিন্ডার ও রিফুয়েলিং নিয়ে চলছে ভয়াবহ অনিয়ম। সংযোজনের পাঁচ বছরের মাথায় সিলিন্ডার রি-টেস্ট বাধ্যতামূলক হলেও বাস্তবে প্রতিফলন নেই। একইভাবে ফিলিং স্টেশনে রিফুয়েলিংয়ের আগে সিলিন্ডার মেয়াদোত্তীর্ণ যাচাইয়ের কথা থাকলেও কেউ তা না মানায় দিন দিন গ্যাস সিলিন্ডারে বিস্ফোরণে মৃত্যু ঝুঁকি বেড়েই চলছে। এতে প্রাণহানির পাশাপাশি অপচয় হচ্ছে সম্পদেরও।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সিএনজি সিলিন্ডারে প্রতি বর্গইঞ্চিতে ৩২শ’ পাউন্ড চাপে গ্যাস ভরা হয়। এ সময় গাড়ি ভয়াবহ বোমা হয়ে বিস্ফোরণের বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। এ আশঙ্কা রোধে গ্যাস সিলিন্ডারের সঠিক মান রক্ষা করা জরুরি। বাধ্যবাধকতা থাকলেও সিএনজিচালিত গাড়ির পাঁচ বছরের বেশি পুরনো সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষায় কেউ উদ্যোগী হচ্ছে না। রিটেস্টের মেয়াদোত্তীর্ণ বেশিরভাগ গাড়ি বিপজ্জনক সিলিন্ডার নিয়ে প্রতিদিন রাস্তায় চলছে।

পরিবেশবান্ধব ও স্বল্পমূল্য হওয়ার দেশে দিন দিন গাড়িতে সিএনজি বা রুপান্তরিত গ্যাস ব্যাপক জনপ্রিয় হচ্ছে। ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের গণপরিবহন, ট্যাক্সিক্যাব, অটোরিকশা কিংবা হিউম্যান হলার সব বাহনেই সিএনজি সিলিন্ডারের বিকল্প ভাবা যেন দায়। কিন্তু এই চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কয়েকটি অসাধু চক্রের হাতে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে অননুমোদিত সিএনজি কনভারসন প্রতিষ্ঠান। এসব জায়গা থেকে সেবা নিতে গিয়ে বিপাকে পড়ছে সাধারণ মানুষ। যার খেসারত দিতে হয়েছে জীবনের মূল্য দিয়ে।

গত শনিবার কুমিল্লায় সিএনজি অটোরিকশার সিলিন্ডার বিস্ফোরণে শিশুসহ ৫ যাত্রী দগ্ধ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জেলা ট্রাফিক পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ওই যাত্রীরা ব্রাহ্মণপাড়া থেকে কুমিল্লা শহরে আসছিলেন। তাদের বহনকারী সিএনজিটি অটোরিকশাটির সিলিন্ডার শাসনগাছা ফ্লাইওভার থেকে নামার পর হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এ সময় চালক লাফ দিয়ে বেঁচে গেলেও আহত হন গাড়িতে থাকা পাঁচজন যাত্রী।
কুমিল্লা ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আলী আজম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের হয়ে আগুনের সূত্রপাত হয়। আমাদের দু’টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে ২০ মিনিটের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।

এর আগে গত ৯ জুন কক্সবাজারের চকরিয়ায় মেয়াদোত্তীর্ণ সিএনজি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৮ বছরের এক শিশু ও তার মা আগুনে দগ্ধ হয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশুটি মারা যায়।

কেন এই দুর্ঘটনা? কিংবা এর পেছনের কারণগুলোই বা কী? এবিষয়ে কথা হয় এলপিজি ইন্ডাস্ট্রিায়ালের বিক্রয় ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান জালালের সঙ্গে। তিনি দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ হলো নিম্নমানের কম পুরুত্ববিশিষ্ট সিলিন্ডার ব্যবহার করা। একই সঙ্গে পুরোনো অচল হয়ে যাওয়া সিলিন্ডারের পুনর্ব্যবহার যেগুলো স্থানীয় গ্যারেজ কিংবা মেকানিকদের কাছ থেকে রূপান্তরের কাজ করানোর কারণে বাহ্যিকভাবে শনাক্ত করার উপায় থাকে না। অননুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে রূপান্তরের কাজ করালে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকেই যায়। তাই সরকার অনুমোদিত তথা রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) স্বীকৃত কনভারসন প্রতিষ্ঠান থেকে অবশ্যই এই রূপান্তরের কাজ করানোর জন্য পরামর্শও দেন তিনি।

এদিকে দীর্ঘদিন ব্যবহারের কারণে সিলিন্ডারে অনেক সময় খুব ক্ষুদ্র ক্ষয় হয়ে থাকে, যেগুলো খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু বিভিন্ন পরীক্ষায় বের হয়ে আসে। এই ক্ষয় থেকেও ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। সিএনজি নিয়ে অনিয়ম চললেও দেখভালের দায়িত্বে থাকা বিস্ফোরক অধিদপ্তর অনেকটাই নির্বিকার। গত এক বছর ধরে নকল সিলিন্ডারের বিরুদ্ধে দেশের কোথাও কোনো অভিযানও হয়নি। তবে এ বিষয়ে বিস্ফোরক অধিদফতরের কর্মকর্তা আব্দুল হাকিম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন ‘সিএনজি গাড়ির অনিয়মের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস লিমিটেডের (আরপিজিসিএল)। কিন্তু সবাই দায় চাপায় বিস্ফোরক অধিদফতরের ওপর। তবে করোনা ও লোকবল সঙ্কট কারণে অনেকদিন অভিযান চালানো যায়নি বলেও বিস্ফোরক অধিদফতরের এই কর্মকর্তা স্বীকারও করেছেন।

বিস্ফোরক অধিদফতর সূত্রে আরো জানা গেছে, ডিজেল ও পেট্রোলের ওপর চাপ কমাতে ২০০২ সাল থেকে দেশে জ্বালানি সিএনজির ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, সিএনজিতে রূপান্তরিত এসব গাড়ির পাঁচ বছরের প্রাথমিক মেয়াদ অতিক্রম হয়ে গেছে। শতকরা একভাগ গাড়িও রি-টেস্টের জন্য আসেনি। দেশের মহাসড়কগুলোতে ৩ লাখেরও বেশি সিএনজি চালিত গাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলাচল করছে। বেশিরভাগ সিলিন্ডার গাড়ির পেছন দিকে বা মাঝামাঝিতে থাকায় দুর্ঘটনা ঘটলে ভয়াবহ প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। সরকার শিগগিরই কঠোর পদক্ষেপ না নিলে আগামী এক বছরে সিএনজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা অনেক বেড়ে যাবে।

গত দেড় বছর ধরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। নকল সিলিন্ডার, মানহীন সিলিন্ডার বাল্ব ও এসেস পাইপের পরিবর্তে এমএস পাইপ ব্যবহারের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে বেশি। বিস্ফোরক অধিদফতর ও আরপিজিসিএল সূত্র জানায়, সিএনজি সিলিন্ডারগুলোর ধারণক্ষমতা ৩ হাজার পিএসআই (প্রেসার পার স্কয়ার ইঞ্চি)। কিন্তু রিফুয়েলিং স্টেশনে গ্যাসভর্তি করা হয় প্রায় ৫ হাজার পিএসআইয়ে। প্রতিনিয়ত বাড়তি চাপ নিতে হয় বলে পুরু ইস্পাতে সিলিন্ডারগুলো তৈরি করা হয়। একেকটি সিলিন্ডারের সর্বোচ্চ মেয়াদ ২০ বছর হলেও বাড়তি চাপের কারণে ৫ বছর অন্তর অন্তর রি-টেস্ট জরুরি। তবে এর চেয়েও ঝুঁকির বিষয় হলো অক্সিজেন সিলিন্ডারকে গ্যাস সিলিন্ডার বানানো। একটি সূত্র জানায়, মেয়াদোত্তীর্ণ অক্সিজেন সিলিন্ডার ও শিপইয়ার্ড থেকে গ্যাস সিলিন্ডার সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন মহাড়কের পাশে ওয়ার্কশপে অবৈধভাবে সিএনজি সিলিন্ডার বানানোর ঘটনা ঘটছে। মাত্র ৫-১০ হাজার টাকা কমের জন্যই গাড়ি মালিকরা নকল সিলিন্ডার ব্যবহারে ঝুঁকে পড়ছে।

সিএনজি চালক ইমরান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, নতুন গাড়ির সঙ্গে যে সিলিন্ডারগুলো আসে সেগুলো পাঁচ বছরের বেশি সময় যায়। তার গাড়ি বয়স ৬ বছরের উপরে। এখনো পুরানো সিলিন্ডার দিয়েই চলছে। সিএনজি কনভারশন সেন্টারের এক মালিক মনির হোসেন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সিএনজি সিলিন্ডারের তুলনায় অক্সিজেন সিলিন্ডারের ধারণ ক্ষমতা অর্ধেক। তাই দুর্ঘটনার ঝুঁকিও অনেক বেশি। একই প্রসঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার নাইমুল সিএনজি অটোমোবাইলস ওয়ার্কশপের মালিক নুরুল ইসলাম জানান, সিলিন্ডার কনভারশনের সময় হাইপ্রেসার, শাটার, সুইচ মিটার ওয়েরিং, ক্লাম্প, ক্লিপ ও টাইনিং রিলে লাগাতে হয়। দীর্ঘদিনের ব্যবহারের ফলে এগুলোর কোনোটি নষ্ট হলে সিলিন্ডার বিম্ফোরণ ঘটতে পারে।

কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)-এর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, বাজারে গুণগত সিলিন্ডার আসছে না। গাড়িগুলো সিলিন্ডার সঠিক সময় পরীক্ষা করছে না। মান ঠিকমত যাচাই হচ্ছে না। ফিটনেস দেখা হচ্ছে না। মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের সিলিন্ডার ব্যবহার এখন জীবন্ত বোমায় পরিণত হচ্ছে। পাঁচ বছর পর পর রিটেস্ট না করাসহ বিভিন্ন কারণে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও হতাহতের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি ব্যর্থ। নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তা ব্যক্তিরা ঘুষ খেয়ে সুবিধা দিচ্ছে। এদিকে মানুষের জীবন যাচ্ছে। জীবন রক্ষার অধিকার হারাচ্ছে জনগণ। দেশে সুশাসনের অভাবেই এসব ঘটনা ঘটছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

https://www.dailyinqilab.com/article/351261