১৮ জানুয়ারি ২০২১, সোমবার, ১১:৫৬

ফাইজারের টিকা নিয়ে বাড়ছে সন্দেহ সংশয়

ইবরাহীম খলিল : বিশ্বের কয়েকটি দেশে ফাইজার উদ্ভাবিত টিকা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। কয়েকটি দেশে টিকা গ্রহণ করার পর মৃত্যুর ঘটনায় ভীতি ছড়িয়ে পড়ছে। একইসাথে টিকা গ্রহণের ব্যাপারে অনীহা বাড়ছে মানুষের মধ্যে। ফলে অনেকেই টিকা নেয়ার ব্যাপারে অনীহা দেখাচ্ছে। টিকা নিতে অনীহা জানিয়েছে ভারতের চিকিৎসকদের একাংশ। এই টিকা আনার জন্য ভারতের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে বাংলাদেশের। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি করোনাভাইরাসের টিকার প্রথম চালান আগামী ২৫ জানুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছাবে বলে আশা করছে সরকার।

মার্কিন কোম্পানি ফাইজারের তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নরওয়ে। দেশটি বলেছে, ফাইজারের তৈরি এ টিকা বয়স্ক লোকজনের জন্য মারাত্মক রকমের ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশটিতে এরইমধ্যে ফাইজার-বায়োনটেক উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের টিকা গ্রহণ করার পর বয়স্ক লোকজনের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ২৯ জনে দাঁড়িয়েছে। শুক্রবার পর্যন্ত নরওয়েতে শুধুমাত্র ফাইজার-বায়োনটেকের টিকাই পাওয়া যাচ্ছিল এবং যে সমস্ত বয়স্ক মানুষের মৃত্যু হয়েছে তারা সবাই এই টিকা গ্রহণ করেছিলেন। মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল ব্লুমবার্গের এক প্রশ্নের লিখিত জবাবে শনিবার নরওয়ের মেডিসিন এজেন্সি এই কথা বলেছে। সংস্থাটি বলেছে, যে ২৯ জন মারা গেছেন তার মধ্যে ১৩ জনের মৃত্যুর ঘটনা মূল্যায়ন করা হয়েছে এবং বাকি ১৬ জনের ঘটনাও মূল্যায়ন করা হচ্ছে। ফাইজার-বায়োনটেক উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের টিকা দেয়ার পর যে ২৯ জন মারা গেছেন তাদের সবার বয়স ৭৫ থেকে ৮০ ছিল। আমেরিকাতে ডিসেম্বর মাসের ১৪ থেকে ২৩ তারিখের মধ্যে ১৯ লাখ মানুষকে এই টিকা দেয়া হয়েছে এবং টিকা গ্রহণের পর অন্তত ২১ জন মারা গেছেন বলে মার্কিন প্রশাসন জানিয়েছে। ফাইজার-বায়োনটেক উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে পুরো ইউরোপের নিরাপত্তা রিপোর্ট জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে প্রকাশ করা হবে।

ফাইজারের টিকা নেওয়ার ১৬ দিন পর মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন চিকিৎসক। এ ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে ফাইজার কর্তৃপক্ষ। ব্রিটিম গণমাধ্যম জানায়, গ্রেগরি মাইকেল (৫৬) নামের ওই ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ (গাইনোকলজিস্ট) ফ্লোরিডার মায়ামিতে কর্মরত ছিলেন।
২০২০ সালের ১৮ ডিসেম্বর তিনি ফাইজারের করোনা টিকা গ্রহণ করেছিলেন। তার স্ত্রী হিদি নেকলম্যান ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে দাবি করেন, টিকা নেওয়ার সময় সুস্থ ছিলেন গ্রেগরি। এমনকি তার কোনা রোগ প্রতিরোধ বিষয়ক বিশৃঙ্খলাও ছিল না। তবে টিকা নেওয়ার পর তিনি ইডিওপ্যাথিক থ্রোমবোসাইটোপেনিক পারপুরা (আইটিপি) জনিত স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। এ সময় তার রক্তে প্লেটিলেটসের ঘাটতি দেখা দেয়।
এদিকে ফাইজার ভ্যাকসিনে মৃত্যুর ঘটনায় নরওয়ের জরুরি পরামর্শ চেয়েছে অস্ট্রেলিয়া। একইসঙ্গে বিষয়টি নিয়ে ফাইজার কর্তৃপক্ষেরও বক্তব্য চেয়েছে ক্যানবেরা। কেননা, ভ্যাকসিনটির এক কোটি ডোজ কিনতে ফাইজারের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ারও চুক্তি রয়েছে। ফলে এ নিয়ে যাবতীয় সংশয় দূর করতে চায় দেশটি। ভারতে প্রথম ধাপে করোনার ভ্যাকসিন নেয়ার পর ৫২ জনের শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এদের মধ্যে ৫১ জনের মৃদু প্রতিক্রিয়া হলেও গুরুতর অবস্থায় একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দিল্লীতে কয়েক জনের শরীরে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণে রাখার পর তারা ঠিক হয়ে যায়। তবে মারাত্মক মাথাব্যথা, রেশ বের হওয়া এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়ায় একজনকে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসায় উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসকেরা অ্যাড্রেনালিন ব্যবহারের মাধ্যমে তাকে স্থিতিশীল রেখেছেন। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভ্যাকসিন নেয়ার পর কোন সমস্যা দেখা দিলে তা টিকা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নাও হতে পারে। এদিকে, কোভ্যাক্সিন এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ক্ষতিপূরণ দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে ভারত বায়োটেক।

নরওয়ের চিকিৎসা নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দুর্বল রোগীদের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন নেওয়ার পর সাধারণ জ্বর ও বমি বমি ভাবের মতো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে। কিছু দুর্বল রোগীদের জন্য এটি মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। ব্লুমবার্গের শনিবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ভ্যাকসিন গ্রহণের পর বয়স্কদের মৃত্যুর জেরে অতিবৃদ্ধ ও দীর্ঘমেয়াদে অসুস্থ মানুষের জন্য ফাইজারের ভ্যাকসিনকে ‘মারাত্মক ঝুঁকি’ হিসেবে অভিহিত করেছে নরওয়ে। ফলে করোনা টিকার সুরক্ষা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে নতুন করে সংশয় দেখা দিয়েছে।

নরওয়ের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এরইমধ্যে ১৩ জনের মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখা হয়েছে।’ সবগুলো মৃত্যুই ‘বয়স্কদের, যারা টিকা নেওয়ার পর ভয়ানক শারীরিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিলেন।’ বাকী ১৬ জনের মৃত্যুর ঘটনাও তদন্তাধীন। স্থানীয় সময় শুক্রবার নরওয়েজিয়ান মেডিসিন এজেন্সির চিফ ফিজিশিয়ান সাইগার্ড হোর্তেমো বলেছিলেন, টিকা নেওয়ার পর জ্বর ও বমি বমি ভাবের সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সঙ্গে ‘কিছু কিছু দুর্বল রোগীর ক্ষেত্রে তা ভয়াবহ পরিণতি’ নিয়ে আসতে পারে।

করোনার মহামারি অবসানে তড়িঘড়ি করে টিকার অনুমোদন নিয়ে আগে থেকেই সমালোচনা হচ্ছিল। এমন সময় ইউরোপের দেশটির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে টিকার সুরক্ষা নিয়ে এমন সতর্কবার্তা আসলো।

গত ডিসেম্বর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ফাইজার এবং জার্মানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেকের যৌথ উদ্যোগে তৈরি করোনা ভ্যাকসিন ‘কমিরনাটি’ র প্রথম ডোজ গ্রহণ করেছেন নরওয়ের ৩০ হাজারেরও বেশি অধিবাসী। ঝুঁকি বিবেচনায় প্রথম ধাপে দেশটিতে বয়োজ্যেষ্ঠদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেয়া হচ্ছিল। অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও ইউরোপে সাময়িকভাবে ভ্যাকসিন সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে ফাইজার। নরওয়ের জনস্বাস্থ্য সংস্থা (এফএইচআই) অবশ্য জানিয়েছে, ফাইজার তাদের বার্ষিক উৎপাদন ১৩০ কোটি থেকে ২০০ কোটিতে উন্নীত করার জন্যই আপাতত সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে।

এদিকে ভারতে গত শনিবার শুরু হয়েছে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার কর্মসূচি। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। তবে দেশীয় টিকা কোভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা নিয়ে আতঙ্ক থেকেই গেল। কোভ্যাক্সিন নিতে অস্বীকার করলেন দিল্লির রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। তাদের ভাষ্য, ট্রায়াল শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা কোভ্যাক্সিন নেবেন না। টিকা হিসেবে কোভিশিল্ড-ই তাদের প্রথম পছন্দ। আতঙ্কে অনেক চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী টিকাকরণ প্রক্রিয়ায় অংশই নিচ্ছেন না। এ কারণে ভ্যাকসিন নেওয়ার তালিকায় নামই লেখাননি অনেক চিকিৎসক। এ প্রসঙ্গে নীতি আয়োগের সদস্য ভি কে পল বলেন, ‘কোভ্যাক্সিন সম্পূর্ণ নিরাপদ। চিকিৎসকদের সরকারের ওপর ভরসা রাখা উচিত।

ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়, এআইআইএমএস, আরএমএল ও সফদার জং হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের ভারত বায়োটেকের ‘কোভ্যাক্সিন’ এবং বাকি দুই হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার ‘কোভিশিল্ড’ দেওয়ার কথা রয়েছে। এআইআইএমএস’র ১২ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে ১৫০ জনকে প্রথম তালিকায় রাখা হয়। কিন্তু, তাদের মধ্যে ৫০ জনেরও কম কর্মী ভ্যাকসিন নিতে রাজি থাকার কথা জানিয়েছেন।

হাসপাতালটির ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী কয়েকজনের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমটির পক্ষ থেকে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তাদের কারো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। অজুহাত হিসেবে কেউ বলেছেন যে তারা করোনা থেকে সুস্থ হয়ে গেছেন, আবার কেউ বলেছেন তারা দিল্লির বাইরে রয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এআইআইএমএস’র এক স্বাস্থ্যকর্মী সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছেন, ‘আমরা ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে নই। আমি সবাইকে ভ্যাকসিন নিতে বলব। তবে যে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল এখনো শেষ হয়নি সেই ভ্যাকসিন নিতে আমি প্রস্তুত নই।

আমাদের অধিকাংশই গিনি পিগ হতে চান না,’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেছেন, ‘এটি হচ্ছে ভ্যাকসিনের বৃহৎ ট্রায়াল। যদিও তালিকায় নাম দেয়া হয়েছে তারপরও আমাদের অধিকাংশই আরও অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

লোকনায়ক হাসপাতালের মাত্র ৭৫ স্বাস্থ্যকর্মী ভ্যাকসিন নিতে রাজি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫৮ জন চিকিৎসক এবং ১১ জন নার্স। কয়েকজনের বয়স ৫০ বছরের বেশি হওয়ায় তাদেরকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। তালিকার অধিকাংশ চিকিৎসক সিনিয়র রেসিডেন্ট ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী।

https://dailysangram.com/post/440922