১৭ জানুয়ারি ২০২১, রবিবার, ১১:২২

ভারত থেকে টিকা আমদানির খরচ বেশি : তাই অবিলম্বে বিকল্প উৎস বের করতে হবে

আসিফ আরসালান : বাংলাদেশ যে ভারতের চেয়ে ৪৭ শতাংশ বেশী দামে করোনা ভ্যাকসিন কিনছে সেই বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে মর্যাদাবান সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের এই খবরটি গত ১২ জানুয়ারি ইংরেজী ‘ডেইলি স্টারের’ অনলাইন বাংলা সংস্করণের শিরোনাম, “ভারতের চেয়ে ৪৭ শতাংশ বেশী দামে ভ্যাকসিন কিনবে বাংলাদেশ : রয়টার্স।” খবরে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড এ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা ভ্যাকসিনের প্রতি ডোজ চার ডলারে কিনবে। এতে ভারতের তুলনায় অন্তত: ৪৭ শতাংশ বেশী খরচ হবে বাংলাদেশের। বিষয়টির সাথে সংশ্লিষ্ট ৩টি সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স এই তথ্য জানিয়েছে। একটি সূত্রের বরাত দিয়ে জানানো হয়, ভারত সরকারের কাছে প্রথম ১ কোটি ১০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিনের প্রতি ডোজ ২০০ ভারতীয় রুপি বা ২ দশমিক ৭২ ডলারে বিক্রির প্রাথমিক চুক্তি করেছে সিরাম। এ বিষয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য সচিবের সাথে রয়টার্স যোগাযোগ করেও কিছু জানতে পারেনি। তাদের মন্তব্য জানা যায়নি। সোজা বাংলায় বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে যে, ভারত অক্সফোর্ড থেকে সিরাম কিনছে প্রতি ডোজ ১ দশমিক ৭২ ডলারে। সিরাম সেটি বেক্সিমকোর কাছে বিক্রি করছে ৪ ডলারে। অর্থাৎ ভারত প্রতি ডোজে ২ দশমিক ২৮ ডলার বেশী নিচ্ছে। বেক্সিমকো আবার সেটি বিক্রি করছে বাংলাদেশ সরকারের কাছে ৫ ডলারে। অর্থাৎ এখানে বেক্সিমকোর মুনাফা ১ ডলার। অবশ্য বেক্সিমকোর পুরা মুনাফা ১ ডলার নয়। কারণ মাঝখানে রয়েছে ভারত থেকে আনার পরিবহন খরচ এবং দেশে সংরক্ষণ ও বিতরণ খরচ। আবার সিরামের মার্জিনও পুরা ২ দশমিক ২৮ ডলার নয়। কারণ এখানেও রয়েছে বাংলাদেশে পাঠানোর পরিবহন খরচ। দেখা যাচ্ছে যে সিরামের ক্রয় খরচ (১ দশমিক ৭২ ডলার) এবং বাংলাদেশের মোট ক্রয় খরচের ফারাক ৩ দশমিক ২৮ ডলার হলেও পরিবহন ও সংরক্ষণ খরচ বাবদ ১ ডলার বাদ দিলে বাংলাদেশকে নীট অধিক মূল্য দিতে হচ্ছে ২ দশমিক ২৮ ডলার। ৩ কোটি ডোজে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত মূল্য দিতে হচ্ছে ৬ কোটি ৬৪ লক্ষ ডলার। এখন এই অঙ্ককে ৩ কোটি দিয়ে গুণ করুন। তারপর ডলারের বিনিময় হার ৮৫ টাকা দিয়ে এই অঙ্ককে গুনন করুন। তাহলে বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশ সরকারকে কত হাজার কোটি টাকা বেশী গচ্চা দিতে হচ্ছে আর বেক্সিমকো কত শত কোটি টাকা মুনাফা লুটছে। প্রশ্ন হলো, বিদেশ থেকে ভ্যাকসিন আনার কাজে অনাবশ্যক এবং অপ্রাসঙ্গিকভাবে বেক্সিমকোকে আনা হলো কেন? প্রথমে বড় বড় আমলারা বলেছিলেন যে এটি নাকি একটি জি টু জি চুক্তি। অর্থাৎ এক সরকারের সাথে আরেক সরকারের চুক্তি। অর্থাৎ ভারত সরকারের সাথে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি। কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে যে ভারত এই চুক্তির ধারে পাশেও নাই। তাহলে বাংলাদেশ সরকার এই চুক্তিতে জড়িত হলো কিভাবে? জড়িত যখন হলোই তখন সরাসরি সিরামের সাথে চুক্তি করা যেত। তাহলে তো বেক্সিমকো যেটা পাচ্ছে সেই ৩ কোটি ডলার বেঁচে যেত।

॥ দুই ॥

এই চুক্তির মধ্যে আরো যে কত শুভঙ্করের ফাঁক রয়েছে সেটি কে জানে? কারণ এখন আবার শোনা যাচ্ছে যে বেক্সিমকো নাকি এই টিকা প্রাইভেট সেক্টরে অর্থাৎ বেসরকারি খাতেও বিক্রি করবে। এখানে নাকি বিক্রয় মূল্য ধরা হয়েছে ১৩ দশমিক ২৭ ডলার। অর্থাৎ ১১২৫ টাকা। এতদিন ধরে বলা হয়েছে যে দেশের সব মানুষকে সরকার বিনামূল্যে টিকা দেবে। তাহলে খোলা বাজারে ১১২৫ টাকা ডোজ টিকা বিক্রির জন্য বেক্সিমকোকে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে কেন? এসব বিষয় দেশের কোটি মানুষের কাছে অস্পষ্ট রয়েছে। এখানে ফার্স্ট পার্টি এবং প্রিন্সিপাল পার্টি হলো ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট। বেক্সিমকো হলো এখানে সিরামের লোকাল এজেন্ট। এখানে বাংলাদেশ সরকার কিভাবে একটি পার্টি হয়? বাংলাদেশ সরকার যদি একটি পার্টি হতে পারে তাহলে ভারত সরকার কোনো পার্টি হলো না কেন? এই ধরনের অসংখ্য প্রশ্ন এই চুক্তিকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে। এজন্য এ বিষয়ে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে চুক্তিটি জন সমক্ষে প্রকাশ করা হোক। আবার কেউ কেউ দাবী করেছেন যে চুক্তিকে ঘিরে জনমনে যেসব প্রশ্নের উদয় হয়েছে সেগুলোর নিরসনের জন্য বাংলাদেশ ও ভারত, উভয় দেশের তরফ থেকে একটি যৌথ বিবৃতি দেওয়া হোক। এই চুক্তির মধ্যে মূল্য নির্ধারণ, পরিবহণ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সম্পর্কে নিশ্চয়ই আলোকপাত করা হয়েছে।

ভারত কেন বেশী দাম নিচ্ছে এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য পরিষ্কার নয়। তিনি মনে হয়, বিয়ষটিকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কোনো দেশ যদি ভ্যাকসিনের দাম বেশী বলে তবে অন্য দেশ থেকে আনার চেষ্টা করা হবে। প্রাইস বেশী হয়েছে কিনা। ইন্ডিয়া যদি তৈরী করে তাহলে তাদের প্রোডাকশন কস্ট তো কম হবেই। যখন তারা বিক্রি করবে তখন তারা প্রোডাকশন কস্ট এবং প্রফিট যোগ করবে। তাদের যে খরচ হবে সেই দামে আমরা পাবো, এটা প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। তবে আমরা দেখবো, আন্তর্জাতিক বাজারে কত দাম। কারণ এক দেশ তো ভ্যাকসিন তৈরী করে না। অন্যান্য দেশও তো করে। এক দেশ যদি বেশী দাম বলেন, তাহলে আমরা অন্য দেশে যাবো। সেই সুযোগ আমাদের আছে।

অবাক হতে হয় যে অর্থমন্ত্রী এখনও জানেন না যে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে বেশী দাম নিচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষতো জানেই, এমনকি রয়টার্সও সেটা জানে। আর অর্থমন্ত্রী সেটি জানেন না, সেটি কি হতে পারে? বলেছেন, প্রয়োজনে অন্য দেশের কাছে যাবেন। কবে যাবেন? সরকার জানেন না যে চীনের সিনোভ্যাকের জন্য বেশ কয়েকটি দেশ হামলে পড়েছে। তুরস্ক ৫ কোটি ডোজের অর্ডার দিয়েছে। ইন্দোনেশিয়া প্রথম পর্যায়ে চায় ১০ কোটি ডোজ সিনোভ্যাক। গণহারে সিনোভ্যাক টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্টকে দিয়ে। তিনি সর্বাগ্রে দিয়েছেন। এই কলাম লেখার এই পর্যায়ে জানা গেল যে ২ কোটি ৯০ লক্ষ ডোজ ইতোমধ্যেই ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছে গেছে। এছাড়াও ব্রাজিল এবং চিলিও চীনের ভ্যাকসিন ব্যবহার করছে।

॥ তিন ॥

আজ এসে অর্থমন্ত্রী বলছেন যে দাম বেশী হলে অন্য দেশে যাবো। আজ নয়, সেই ৪ মাস আগে, অর্থাৎ গত সেপ্টেম্বরে চীনের সিনোভ্যাক বাংলাদেশে তৃতীয় এবং ফাইনাল ট্রয়াল দিতে চেয়েছিল। সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হলো কেন? শুধুমাত্র প্রত্যাখ্যান নয়, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি ড. নজরুল ইসলামের ভাষায় প্রস্তাবটি অসম্মানজনকভাবে (Undignified manner) প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে (New Age: January 5, 2021)। একই মত পোষণ করেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রফেসর সাইদুর রহমান, বিএমএ এর প্রাক্তন সভাপতি অধ্যাপক মাহ্বুব-ই-রশিদ, ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রমুখ। অভিজ্ঞ মহলের সন্দেহ, করোনা ভাইরাসের মতো একটি ভয়ংকর মহামারী মোকাবেলার ক্ষেত্রেও একান্তভাবে ভারত নির্ভরতার জন্যই এটা করা হয়েছে।

যাই হোক, বলা হচ্ছে যে ২৫ জানুয়ারির মধ্যে টিকা পাওয়া যাবে এবং ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে সেটি মানবদেহে প্রয়োগ করা শুরু হবে। প্রশ্ন উঠেছে, কারা আগে পাবে? এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে সরকারের সুস্পষ্ট কোনো গাইড লাইন ঘোষণা করা হয় নাই। একেক পত্রিকায় একেক রকম খবর ছাপা হচ্ছে। সবই এক্সক্লুসিভ।

ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ৫০ লক্ষ কোভিশিল্ড ভারত থেকে আসার কথা। প্রথমে বলা হয়েছিল যে প্রথম ডোজ দেওয়ার ২৮ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। তাই ঐ ৫০ লক্ষ ডোজ দুই ভাগ করে ২৫ লক্ষ লোককে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অক্সফোর্ড থেকে বলা হয়েছে যে প্রথম ডোজ দেওয়ার ২ মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। সুতরাং এখন নাকি সিদ্ধান্ত হয়েছে যে প্রথম বার ৫০ লক্ষ মানুষকেই একসঙ্গে টিকা দেওয়া হবে। এরমধ্যে পরবর্তী ৫০ লক্ষ ডোজের চালান এসে পড়বে।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক, প্রথম ধাপে কারা টিকা পাবে সে ব্যাপারে সরকার নাকি একটি তালিকা করেছে। সেই তালিকায় ২১ টি শ্রেণীতে রয়েছে ৫২ লক্ষ ১৩ হাজার মানুষ। এই ২১ ক্যাটাগরির মধ্যে কারা ওপরের দিকে রয়েছে সেটি বলা হয়নি। তবে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, জার্মানি প্রভৃতি দেশে করোনা মোকাবেলায় সম্মুখ যোদ্ধা (Front Liners) এবং প্রবীণ নাগরিক বা সিনিয়র সিটিজেনদেরকে ১নং প্রাইয়োরিটি বা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশেও সেটি অনুসরণ করতে হবে। বলা বাহুল্য, প্রবীণদের মধ্যেও ৮০ ও উর্ধ্ব, ৭৫-৮০, ৭০-৭৫, ৬৫-৭০ - এভাবে প্রবীণদের শ্রেণী বিন্যাস করতে হবে। এই তালিকা প্রণয়ন করতে গিয়ে স্বজনপ্রীতি যেন না হয়।

asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/440818