বাংলাদেশের মানবাধিকার ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বেগ জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। জানা গেছে, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্রাসেলসে এক আলোচনায় এ বার্তা দেওয়া হয়। বৈঠকে যৌথভাবে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক ও ইউরোপীয় এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এশিয়া ও প্যাসিফিক) গিউনার উইগ্যান্ড। ওই বৈঠক শেষে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে উদ্বেগের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়। তবে এ সপ্তাহে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে শ্রম অধিকারবিষয়ক এক প্রশ্নের উত্তরে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সেখানে আরো বলা হয়, পরিস্থিতির উন্নয়নে ইইউ চাপ অব্যাহত রাখবে এবং সম্ভাব্য ব্যবস্থাগুলো প্রয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করবে।
জানা গেছে, ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ‘অ্যালায়েন্স ফর লিবারেলস অ্যান্ড ডেমোক্রেটস ফর ইউরোপ (এএলডিই)’ দলীয় সদস্য ইলহান কিইউচিউক গত নভেম্বরে ইউরোপীয় কমিশনের কাছে বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিষয়ে জানতে চান। তিনি বলেন, আকারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের অবস্থান চীনের পরেই। প্রায় সাড়ে তিন হাজার কারখানা নিয়ে গড়া এ শিল্পে প্রায় ৪০ লাখ কর্মী জড়িত এবং তাঁদের বেশির ভাগই নারী। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৫ শতাংশের প্রায় ৪ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এ খাত জিডিপিতে ১০ শতাংশের বেশি ভূমিকা রাখে।
ইলহান কিইউচিউকের মতে, বাংলাদেশের পোশাক কর্মীরা ইউনিয়ন করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। তারা শারীরিক নির্যাতন, দুর্ব্যবহার, জোরপূর্বক বাড়তি খাটুনি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বেতনসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রত্যাখ্যান এবং যথাসময়ে বা পুরোপুরি বেতন ও বোনাস না পাওয়ার মতো গুরুতর অধিকার লঙ্ঘনের শিকার।
ইলহান কিইউচিউক বলেন, দুঃখজনক হলেও বাংলাদেশে রানা প্লাজা কারখানা ধসের তিন বছর পরও এসব হচ্ছে। রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশ পোশাক শিল্পের পরিস্থিতি উন্নয়নে যে ‘সাসটেইনেবিলিটি কম্প্যাক্ট’ স্বাক্ষর করেছিল তা এখন মেনে চলছে না—এটি তারই প্রমাণ।
ইলহান কিইউচিউক জানতে চান, পোশাক শ্রমিকদের অধিকার উন্নয়নে ও সাসটেইনেবিলিটি কম্প্যাক্টের আওতায় বাংলাদেশ সরকারকে বাধ্য করতে ইউরোপীয় কমিশন কী উদ্যোগ নেবে? তিনি আরো জানতে চান, পোশাক শ্রমিকদের অধিকারের উন্নতি না হলে ইইউতে বাংলাদেশের ‘এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ)’ বাণিজ্য সুবিধা বাতিল করতে কমিশন কি প্রস্তুত আছে?
জবাবে ইউরোপীয় কমিশনের পক্ষে এর বাণিজ্য কমিশনার সিসিলিয়া ম্যালস্ট্রম গত মঙ্গলবার পার্লামেন্টে বলেন, বাংলাদেশকে সহায়তা করতে এবং এর পোশাক শ্রমিকদের অধিকার উন্নয়নে ইইউ তার উন্নয়ননীতি এবং ইইউ-বাংলাদেশ সহযোগিতা চুক্তির আলোকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) পরিচালিত প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ, বার্ষিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক, কম্প্যাক্ট অংশীদারদের সঙ্গে কারিগরি বৈঠক, কম্প্যাক্ট বাস্তবায়নের অগ্রগতিবিষয়ক বার্ষিক প্রকাশনা ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে নিয়মিত সম্পৃক্ততাসহ সাসটেইনেবিলিটি কম্প্যাক্ট বাস্তবায়নের অগ্রগতি ইইউ নিবিড়ভাবে অনুসরণ করে।
সিসিলিয়া ম্যালস্ট্রম বলেন, শ্রম অধিকার সুরক্ষা ও দায়িত্বশীল ব্যবসা সুরক্ষা নিশ্চিত করে এমন বহুপক্ষীয় ফোরাম যেমন জি২০, জি৭, আইএলও এবং ওইসিডিতে ইইউ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
সিসিলিয়া ম্যালস্ট্রম আরো বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ইইউর জিএসপি ইবিএ চুক্তির আওতায় সবচেয়ে অনুকূল বাণিজ্য সুবিধা পেয়ে থাকে। মৌলিক মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার নীতির ধারাবাহিক বা গুরুতর লঙ্ঘনের কারণে ইবিএ সুবিধা স্থগিত হতে পারে।
সিসিলিয়া ম্যালস্ট্রম বলেন, সাসটেইনেবিলিটি কম্প্যাক্ট, কারখানায় শ্রমিকদের সম্মানজনক ও নিরাপদ কাজের পরিবেশকে উত্সাহিত করার মাধ্যমে ইইউ বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পুরোপুরি সম্পৃক্ত থাকবে।
সিসিলিয়া ম্যালস্ট্রম বলেন, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব হক ও ইইএএসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উইগ্যান্ডের যৌথ সভাপতিত্বে ইইউ-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সংলাপে ইইউ বাংলাদেশে মানবাধিকার ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও উদ্বেগ জানিয়েছে। অগ্রগতি অর্জনের জন্য ইইউ বাংলাদেশের ওপর রাজনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখবে এবং এ লক্ষ্যে সব উপায় বিবেচনা করবে।