২৪ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ৮:৪১

ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতিবাজদের চক্রান্তের আশংকা

বাংলাদেশ ব্যাংকে আগুন

স্পর্শকাতর ১৩ ও ১৪ তলা ক্ষতিগ্রস্ত

মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনে বৃহস্পতিবার রাতে আগুন লাগে, নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের তৎপরতা -যুগান্তর
বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল ভবনের ১৩ তলায় হঠাৎ করে আগুন লেগেছে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মাসুদ বিশ্বাসের কক্ষ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে এটি ১৪ তলায় ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। আধা ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ১০টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। সম্পূর্ণ নির্বাপণ হয় রাত ১০টা ৩৪ মিনিটে। এ ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। ঘটনা তদন্তে ব্যাংকের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের এবং ফায়ার সর্ভিসের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতিবাজ, ঋণ খেলাপি ও রিজার্ভ চুরির মূল হোতারা জড়িত থাকতে পারে বলে আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ এ বিভাগ থেকে সব নথি পুড়িয়ে ফেলে বিশেষ একটি মহলের লুটপাটকে আড়াল করার পাঁয়তারা চলছে। ব্যাংকিং খাতে অব্যাহত দুর্নীতি ও ব্যাপক অনিয়মের শাস্তি না হওয়ায় চক্রটি এ ধরনের নাশকতা করার সাহস দেখাতে পারে। বৃহস্পতিবার রাতে ঘটনাস্থলে উৎসুক জনগণের মধ্যে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলতে থাকেন, রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন এক বছরেও প্রকাশ করা হয়নি। সন্দেহভাজন রাঘববোয়ালরা প্রকাশ্যেই ঘুরছেন। অথচ তাদের ধরা হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে আগুন লাগাটাই স্বাভাবিক।
অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান রাত ১২টা ৩৫ মিনিটে ভবন থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এটি একটি স্পর্শকাতর ঘটনা। আইসিটি মন্ত্রণালয় ও বুয়েটের বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে সুপারিশ করব। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শফিকুল ইসলাম রাত সোয়া ১২টার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, এটি কোনো নাশকতা নয়, একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। স্রেফ দুর্ঘটনা। বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, গুরুত্বপূর্ণ কোনো নথিও পোড়েনি। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনার সঙ্গে এটি মেলানো ঠিক হবে না। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে জানা যাবে অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ।
জানা গেছে, আগুন লাগার পরপরই ব্যাংকের নিজস্ব ফায়ার ফাইটিং টিম প্রাথমিকভাবে অগ্নিনির্বাপণের চেষ্টা করেছিল। পরে ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা ১৩ ও ১৪ তলায় পানি ছিটিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রের কি পয়েন্ট ইন্সটলেশন (কেপিআই) এ ভবনে হঠাৎ করে আগুন লাগার ঘটনা স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগের জিএমের কক্ষ থেকে আগুন লাগার বিষয়টি রহস্যজনক।
ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েকটি কারণে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি পরিষ্কার হচ্ছে। প্রথমত অগ্নিকাণ্ডে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৩ ও ১৪ তলা, এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্লোর মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ দুই ফ্লোরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হার্ট বা হৃৎপিণ্ড বলা হয়। কারণ ১৪ তলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশন বিভাগ। সংক্ষেপে ডিওএস বলে। এ বিভাগ দেশের ব্যাংকিং খাতের ঋণসংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ, নজরদারি এবং নীতিনির্ধারণী কাজ করে। দেশের কোনো গ্রাহক ঋণ খেলাপি হলে তার তথ্য এখানে থাকে। পাশাপাশি ঋণ পুনর্গঠন, পুনঃতফসিল এবং ঋণ খেলাপিদের মামলা, শেয়ারবাজার নজরদারিসহ সবকিছু এ বিভাগ দেখাশোনা করে। ফলে এ বিভাগের এসব নথি পুড়ে গেলে ঋণ খেলাপি ও অপরাধীরা আড়ালে থেকে যাবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৩ তলায় বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগ। বিদেশের সঙ্গে সব লেনদেনের বিষয়টি এ শাখা থেকে নজরদারি করা হয়। কোনো দেশের বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা ছাড় করার অনুমোদন, দেশের বাইরে কী পরিমাণ মুদ্রা রয়েছে, কারা দেশের বাইরে মুদ্রা নিয়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের তথ্যও এখানে থাকে। ফলে দেশের ভেতরে এবং বাইরের মুদ্রাবাজারটি এ দুই বিভাগ থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
এ অগ্নিকাণ্ডের মাত্র ১ দিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের রংপুর অফিসে আগুন লাগে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সতর্ক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিষয়টি আমলে নেননি তারা। এছাড়া রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটেছিল ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে। ওই সময়ে ২ দিন বন্ধ ছিল অফিস। অন্যদিকে বৃহস্পতিবারের অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে ৩ দিনের বন্ধ সামনে রেখে। আজ এবং আগামী ২ দিন সরকারি ছুটি। এ সময়ে নিরাপত্তাকর্মীরা ছাড়া ব্যাংকে কেউ থাকেন না। ফলে এ ঘটনাটি ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয় বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। জানা গেছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও বাংলাদেশের আর্থিক নীতিসহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়কে ‘কি পয়েন্ট ইন্সটলেশন (কেপিআই) বা জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা’ তালিকাভুক্তি করেছে। এর ফলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে ব্যাংকের প্রধান ভবনকে এক্সক্লুসিভলি ভিআইপি ভবন হিসেবে চিহ্নিত করে সেখানে আর্চওয়ে মেটাল ডিটেক্টর, হ্যান্ডহেল্ড মেটাল ডিটেক্টর ও গাড়িবোমা রোধ করার জন্য এক্সক্লুসিভ ডিটেক্টর বসানোসহ নিরাপত্তাসংক্রান্ত অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থা চালু করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকে কেপিআই ঘোষণার করার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাদা পোশাকধারী এনএসআই, ডিজিএফআই, ডিবি ও এসবির সদস্যদের নজরদারির আওতায় রয়েছে। সাড়ে পাঁচ হাজার জনবল বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য স্বাধীনতার পর ব্যাংক গঠনের পর থেকেই দাবি তোলা হয়। সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ২০ কর্মকর্তা ছাড়াও পুলিশ ও নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী কর্মরত আছেন।
এর আগে ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওইদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল ৩০ তলা ভবনের চতুর্থ তলার ক্লিয়ারিং হাউসে (নিকাশ ঘর) আগুন লেগে যায়। তবে ব্যাংকের প্রকৌশল বিভাগের লোকজন এসে ৩০ মিনিট চেষ্টা করে আগুন নিভিয়ে ফেলেন।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩০ তলা ভবনের ১৪ তলার দক্ষিণ-পূর্ব কর্নারের একটি কক্ষ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। ওই কক্ষের ১০ থেকে ১৫ ভাগ পুড়ে গেছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়নি। এ ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক সমরেন্দ্র কুমারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত না করে এ বিষয়ে বলা যাবে না। এটা নাশকতা কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটাও তদন্ত শেষ করে বলতে হবে।
আগুন লাগার পর অনেকেই আশংকা করছিলেন আগুনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ বিষয়ে আলী আহমেদ বলেন, আগুনে সার্ভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। শুধু বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগের জিএমের কক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চেয়ার-টেবিল, সিলিং এবং কিছু ফাইলপত্র পুড়ে গেছে।
রাত সাড়ে ১১টার দিকে আলী আহমেদ খান সাংবাদিকদের বলেন, আগুন নির্বাপণে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিটের ৭০ জন ফায়ার ফাইটার কাজ করেছেন। আগুন নির্বাপণের পর তারা ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার শুরু করেছেন।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, আগুন লাগার খবর পেয়ে প্রথমে পাঁচটি ইউনিট ঘটনাস্থলে আসে। পরে পর্যায়ক্রমে তিনটি, দুটি এবং পরে আরও দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে আগুন নির্বাপণের কাজ শুরু করে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণের পর ১৪ তলার কক্ষগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সময় ভবনের ভেতর কেউ ছিলেন না। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকে কিছু সংস্কার কাজ চলছে। তবে রাত সাড়ে ৮টার দিকে সংস্কার কাজে যুক্ত লোকজন বের হয়ে যান। ওই সময় পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। তারা কাজ করে বের হওয়ার পর এ ধরনের ঘটনা ঘটে।
এদিকে আগুন লাগার পর বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের প্রধান ফটকের সামনে এবং ব্যাংকের ভবনের চারপাশে বিপুলসংখ্যক আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেন। মূল গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। আগুন লাগার পর ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, অর্থ প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান, গভর্নর ফজলে কবির, ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসানসহ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।


http://www.jugantor.com/first-page/2017/03/24/111593/