২৪ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ৮:৩৭

অর্থহীন ছড়ার ছড়াছড়ি

পাঠ্যবইয়ের বিষয় নির্বাচন-২

চতুর্থ শ্রেণীর বাংলা বইয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি ছড়ার নাম নেমন্তন্ন। ছড়ার শেষে সারাংশে লেখা হয়েছে ‘এই ছড়াটিকে আসলে একটি হাসির গল্প বলা হয়েছে। একজন লোক ভজন গান শুনতে চাংড়িপোতা নামে একটা জায়গায় যাচ্ছে। পথে এক বন্ধুর সাথে দেখা। বন্ধু একটার পর একটা প্রশ্ন করছে, আর সে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে বোঝা গেল- ভজন গান শোনার চেয়ে তার অনেক বেশি লোভ ভোজনে, অর্থাৎ ভালো ভালো খাবার খাওয়ায়। তার বন্ধু সঙ্গে যেতে চাইলেও সে তাকে নেয় না। কারণ বন্ধু সঙ্গে গেলে তার খাওয়া যদি কম হয়- এই ভয়।’
নেমন্তন্ন শীর্ষক ছড়ার কথাগুলো এ রকমÑ ‘যাচ্ছ কোথা? /চাংড়িপোতা। /কিসের জন্য? /নেমন্তন্ন। / বিয়ে বুঝি? /না, বাবুজি। /কিসের তবে? /ভজন হবে। /শুধুই ভজন? /প্রসাদ ভোজন। /কেমন প্রসাদ? /যা খেতে সাধ। /কী খেতে চাও? ছানার পোলাও। / ইচ্ছে কী আর? /সরপুরিয়ার। / আ: কী আয়েস! /রাবড়ি পায়েস। /এই কেবলি? / ক্ষীর কদলী। / বা: কী ফলার! /সবরি কলার। /এবার থামো। /ফজলি আমও। /আমিও যাই? / না, মশাই।
একজন অভিভাবক এ ছড়া পড়ে বলেন এ দিয়ে শিশুরা কী শিখবে আমরা বুঝতে পারছি না। বরং যদি ছড়ার শেষে নেমন্তন্ন খেতে লোকটিকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হতো তবু বলা যেত ভালো কিছু হলো।
চতুর্থ শ্রেণীর বাংলা পাঠ্যবইয়ে সুকুমার রায়ের একটি কবিতার নাম ‘আবোল-তাবোল’। কবিতার কথাগুলো এ রকম ‘ছুটলে কথা, থামায় কে?/আজকে ঠেকায় আমায় কে? /আজকে আমার মনের মাঝে /ধাই ধপাধপ তবলা বাঁজে- /রাম-খটাখট ঘ্যাচাং ঘ্যাচ /কথায় কাটে কথার প্যাচ। /ঘনিয়ে এলো ঘুমের ঘোর /গানের পালা সাঙ্গ মোর।’
‘আবোল-তাবোল’ কবিতার সারমর্মে লেখা হয়েছে ‘কথা বলার মানে-মনের খেয়ালে কথা বলতে থাকা। আমরা কথা বলি যাতে অন্যে সে কথা শোনে এবং শুনে কিছু একটা করে। যেমনÑ যদি বলি- মা, ভাত খাব, মা তখন আমায় ভাত দিতে ছুটে আসবেন। কিন্তু যদি ভূতের মতো নাকি সুরে বলি ‘আঁউ মাঁউ খাঁউ ভাঁতের গন্ধ পাউ’ তখন মা ভাববেন আমি খেলা করছি। সেটা তখন আবোল তাবোল কথা হয়ে গেল, যে কথার কোনো অর্থ নেই, যে কথা দিয়ে কিছু বোঝাতে চাইছি না। এ কবিতাটি সে রকমই একটি কবিতা, যা জোরে জোরে পড়লেই শুনতে মজা লাগে। একটা লোক মনের আনন্দে কেবলই বকবক করে কথা বলে চলেছে ইচ্ছে হলে গানও গাইছে। যতক্ষণ না দুই চোখে ঘুম নামল ততক্ষণ সে এটাই করে গেল।
প্রথম শ্রেণীতে সুকুমার রায়ের একটি ছড়া রয়েছে ‘হনহন পনপন’ নামে। ছড়ার কথাগুলো এ রকম- চলে হনহন /ছোটে পনপন / ঘোরে বনবন / কাজে ঠনঠন / বায়ু শনশন / শীতে কনকন / কাশি খনখন / ফোড়া টনটন / মাছি ভনভন / ফোড়া টনটন।
নবম দশম শ্রেণীতে ছায়াবাজি নামে সুকুমার রায়ের একটি কবিতা পাঠ্য করা হয়েছে। কবিতার সারাংশে লেখা হয়েছে ‘কবি বলেছেন, আজগুবি নয়- তবু কবির কথা বিশ্বাস হতে চায় না। সত্যি ছায়ার সঙ্গে কি কুস্তি করা যায়? কবি বলেছেন, রোদের ছায়া, চাঁদের ছায়া, বকের ছায়া, চিলের ছায়া, হাল্কা মেঘের পান্সে ছায়া, শুকনো ছায়া, ভেজা ছায়া- এ রকম অসংখ্য ছায়া ধরে তিনি ব্যবসা ফেঁদেছেন। এই ছায়াবাজি বা ছায়ার ব্যবসা অবাস্তব নিশ্চয়। এ ছায়াগুলো অসুখেরও মহৌষধ! অনিদ্রা দূর করতে নিম ও ঝিঙের ছায়া; সর্দিকাশি সারাতে চাঁদের আলোয় পেঁপের ছায়া ; পঙ্গু লোকের নতুন করে পা জন্মাতে আমড়ার নোংরা ছায়া যদি খাওয়া যায় তা হলে এর কোনো তুলনা নেই! কবি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছায়া যতেœর সঙ্গে তুলে রাখেন; কিছু সর্বসাধারণের কল্যাণার্থে নির্ধারিত মূল্যে বিতরণের জন্য রাখেন। আসলে এটি একটি রূপক কবিতা। ছায়া এখানে শিল্পের অমরাত্ম্য হিসেবে বিবেচিত।
ছায়াবাজি কবিতার কয়েকটি লাইন এ রকম -আজগুবি নয়, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা-/ছায়ার সাথে কুস্তি করে গাত্র হলো ব্যথা। / ছায়া ধরার ব্যবসা করি তাও জানো না বুঝি? / রোদের ছায়া চাঁদের ছায়া, হরেক রকম পুঁজি।
অনেক প্রবীণ শিক্ষক বলেন, কবির কবিতা নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। ছড়া, কবিতার বৈশিষ্ট্য বিচারে এগুলো কেবলি ছড়া বা কবিতা মাত্র। কিন্তু এ ধরনের ছড়া, কবিতায় আমাদের কোমলমতি শিক্ষাথীরা কী শিখবে? জোরে জোরে পড়লে শুনতে মজা লাগে এ রকম অসংখ্য ছড়া, কবিতা আছে যাতে শুধু ছন্দ আছে তা নয় বরং সুন্দর অর্থও রয়েছে। যা পড়লে শুধু ভালো লাগে তা-ই নয় মনের মধ্যে এক ধরনের চেতনা এবং বোধের জাগরণ হয়। অসংখ্য কবিতা, ছড়া আছে যাতে ছন্দের পাশাপাশি সুন্দর অর্থ আছে, অনেক কাহিনী আছে, উপদেশ এবং শিক্ষণীয় বা মনে রাখার মতো অনেক কিছু আছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য এ রকম কবিতাই পাঠ্য করা উচিত।
প্রবীণ একজন অভিভাবক বলেন, সুকুমার রায়ের আরো অনেক সুন্দর সুন্দর ছড়া কবিতা আছে যাতে শিশু-কিশোরদের জন্য রয়েছে শিক্ষণীয় উপদেশজাতীয় কথা। যেমনÑ জীবনের হিসাব, পড়ার হিসাব। বিভিন্ন কাসে তার এ ধরনের কবিতা পাঠ্য করা যেত।
জীবনের হিসাব ছড়ার কথাগুলো এ রকমÑ বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই চড়ি শখের বোটে /মাঝিরে কন, ‘বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঁঠে? /চাঁদটা কেন বাড়ে কমে জোয়ার কেন আসে?’ /বৃদ্ধ মাঝি অবাক হয়ে ফ্যালফেলিয়ে হাসে। /বাবু বলেন, ‘সারা জনম মরলিরে তুই খাটি, /জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।’
খানিক বাদে কহেন বাবু ‘বল তো দেখি ভেবে /নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় হতে নেবে?/ বল তো কেন লবণ-পোরা সাগর ভরা পানি?’ /মাঝি সে কয়. ‘আরে মশাই অত কি আর জানি?’ /বাবু বলেন, ‘এই বয়সে জানিসনেও তাকি? /জীবনটা তোর নেহাত খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি। ’/আবার ভেবে কহেন বাবু ‘বল তো ওরে বুড়ো, / কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ওই চূড়ো? /বল তো দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?’ /বৃদ্ধ বলে, ‘আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?’ /বাবু বলেন, ‘বলব কী আর, বলব তোরে কী তা,-/দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।’
খানিক বাদে ঝড় উঠেছে ঢেউ উঠেছে ফুলে, /বাবু দেখেন নৌকাখানি ডুবল বুঝি দুলে। /মাঝিরে কন ‘একী আপদ, ওরে ও ভাই মাঝি, /ডুবল নাকি নৌকো এবার? মরব নাকি আজি?’ /মাঝি শুধায় ‘সাঁতার জানো?’ মাথা নাড়েন বাবু, /মূর্খ মাঝি বলে, ‘মশাই, এখন কেন কাবু? /বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে, / তোমার দেখি জীবনখানা ষোলো আনাই মিছে?’


http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/206301