রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চলছে এক শিশু হৃদরোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সাম্প্রতিক ছবি - মামুনুর রশিদ
২২ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ৯:২৫

বেহাল শিশু হৃদরোগ চিকিৎসা

৬ লাখ রোগীর জন্য ১৬ জন চিকিৎসক

ছোট্ট শিশুকে বুকে আঁকড়ে চিকিৎসকের কক্ষের সামনে অপেক্ষা করছেন মা-বাবা। সিরিয়াল জটে তাদের কেউ কেউ সন্তানকে মেঝেতে বিছানা পেতে শুইয়ে দিয়ে পাশে বসে আছেন। কেউবা বুকে আগলে রেখে কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন। তাদের সবাই হৃদরোগে আক্রান্ত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) শিশু হৃদরোগ বিভাগের সামনে আদরের সন্তানের চিকিৎসার জন্য উদ্বিগ্ন মা-বাবার অপেক্ষার এ চিত্র নিত্যদিনের। শুধু বিএসএমএমইউতে নয়, রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইসিভিডি), ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ও ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু কার্ডিওলজি বিভাগের সামনের চিত্র অনেকটা অভিন্ন। সেখানে শিশু হৃদরোগীর উপচেপড়া ভিড়। এই যখন বাস্তবতা তখন দেশে পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজির (শিশু হৃদরোগ) পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা নেই। এনআইসিভিডি ছাড়া দেশের আর কোনো হাসপাতালে শিশু হৃদরোগীর চিকিৎসা নেই বললেই চলে। সেখানে যতটুকু সেবা দেওয়া হয়, তাও চলছে নানা অব্যবস্থাপনায়। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) ও ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে অল্পবিস্তর শিশু হৃদরোগের সেবা পাওয়া যায়। তবে পরিসংখ্যানে মিলছে অবাক করার মতো তথ্য। ছয় লাখ শিশু হৃদরোগীর জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন মাত্র ১৬ জন। চিকিৎসা পাওয়া যায় মাত্র ছয়টি প্রতিষ্ঠানে।

এনআইসিভিডি ও শিশু হাসপাতালের জরিপ অনুযায়ী, প্রতি হাজারে জীবিত শিশুর মধ্যে ১০ জন জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে পৃথিবীতে আসে। তবে সিএমএইচের তথ্যানুযায়ী সে সংখ্যা আরও বেশি_ ২০ জন। জরিপ অনুযায়ী দেশে অন্তত ছয় লাখ শিশু জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শিশু হৃদরোগীর চাপ

উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছেন এনআইসিভিডি ও বিএসএমএমইউর চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, জন্মের এক মাসের মধ্যে ২০ শতাংশ শিশু হৃদরোগের কারণে মারা যায়।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুল মালিক বলেন, কয়েক বছর ধরে শিশুদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। বিশেষ করে জন্মগত হৃদরোগ উদ্বেগজনক আকার ধারণ করছে। স্বাস্থ্যগত ত্রুটি নিয়ে বেড়ে ওঠা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হুমকির মুখে পড়ছে। সংশ্লিষ্টদের_ বিশেষ করে সরকারকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।

গর্ভাবস্থায় শিশুর হৃদযন্ত্র তৈরি ও বিকশিত হওয়ার প্রাক্কালে কোনো ত্রুটি থাকা এবং শিশু সেই হৃদযন্ত্র নিয়ে ভূমিষ্ঠ হলে তাকে জন্মগত হৃদরোগ বলা হয়। জন্মগত হৃদরোগ অনীলাভ ও নীলাভ_ এ দু'ভাগে বিভক্ত। আক্রান্তের মধ্যে ৭৫ শতাংশই অনীলাভ এবং ২৫ শতাংশ নীলাভ প্রকৃতির। ঘন ঘন ঠাণ্ডা, কাশি ও শ্বাসকষ্ট, মায়ের বুকের দুধ টেনে খেতে অসুবিধা, অল্পতেই হাঁপিয়ে যাওয়া, হাত-পায়ের আঙুল ও ঠোঁট নীলাভ রং ধারণ করা, ওজন ও শারীরিক বৃদ্ধির অপ্রতুলতা ইত্যাদি লক্ষণ জন্মগত হৃদরোগ আক্রান্ত শিশুর মধ্যে দেখা যায়। ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেনের নেতৃত্বে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শিশু জন্মের প্রথম মাসগুলোয় এ রোগ নির্ণয়ের হার কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ে বিলম্ব হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে মুমূর্ষু অবস্থায় রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়। অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন বলেন, জন্মগত হৃদরোগের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা না গেলেও গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ও রাসায়নিক দ্রব্য গ্রহণ, তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শ, মায়ের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ, ভাইরাসজনিত অর্থাৎ রুবেলা সংক্রমণ, শারীরিক স্থূলতা ও পরিবেশগত কারণের সঙ্গে শিশু হৃদরোগের যোগসূত্র রয়েছে। এ ছাড়া বংশগত রোগ ডাউন, টার্নার সিনড্রোম নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুরা এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। রোগ নির্ণয়ে বিলম্ব হওয়ায় আক্রান্ত অর্ধেকেরও বেশি শিশু অকালেই প্রাণ হারায়।

এনআইসিভিডির শিশু হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ শাহরিয়ার বলেন, বাড়িতে জন্ম নেওয়া শিশুদের শারীরিক ত্রুটি সঙ্গে সঙ্গে নজরে আসছে না। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় গর্ভকালীন একজন মা নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মধ্যে থাকেন। আমাদের দেশে অন্তত ৮০ শতাংশ সন্তানসম্ভবা মায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয় না। এ ক্ষেত্রে সচেতনতাও কম। শিশু হৃদযন্ত্রের ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে কি-না তা নিশ্চিত হতে ফিট্যাল ইকো করা হয়। আমাদের দেশে সে সুবিধাও পর্যাপ্ত নয়। সম্প্রতি বিএসএমএমইউতে পরীক্ষাটি চালু হয়েছে। জন্মের আগেই ত্রুটি শনাক্ত করা গেলে সতর্ক হওয়া যাবে। তিনি মনে করেন, সব হাসপাতালে এ পরীক্ষা চালু করা উচিত।

চিকিৎসা চিত্র :বিএসএমএমইউতে ২০০৪ সালে শিশু কার্ডিওলজি ইউনিট চালু করা হয়। বর্তমানে সেখানে সাধারণ ১০টি ও আইসিইউর পাঁচটি শয্যা রয়েছে। এ ইউনিটের তথ্যমতে, গত ছয় বছরে হাসপাতালের ইনডোরে দেড় হাজার ও আউটডোরে প্রায় পাঁচ হাজার শিশু হৃদরোগী সেবা পেয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০ জন শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে। বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, ছোট ও বড়দের হৃদরোগের মধ্যে সূক্ষ্ম অনেক পার্থক্য রয়েছে। সঠিক যন্ত্রপাতির অভাব ও অদক্ষতায় শিশুদের ক্ষেত্রে নিখুঁতভাবে রোগ নির্ণয় করা যাচ্ছে না। শিশু হৃদরোগের শতভাগ সেবা এখন পর্যন্ত দেশে নেই। জটিল ও গুরুতর সমস্যার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ রোগী এখনও বিদেশের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে শিশু কার্ডিয়াক সার্জারি পিছিয়ে রয়েছে। এনআইসিভিডি ও হার্ট ফাউন্ডেশন ছাড়া অন্য কোথাও শিশু হৃদরোগীর সার্জারি হয় না।

এনআইসিভিডির তথ্যানুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ হাসপাতালে এক লাখ ২৫ হাজার ৫৬৭ শিশু হৃদরোগের চিকিৎসা নিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, এখানে প্রতি বছর ৮ হাজার ৩৭২ শিশু হৃদরোগের চিকিৎসা নিয়েছে। তাদের মধ্যে বছরে সাধারণ ও ওপেন হার্ট মিলিয়ে প্রায় ৮০০ সার্জারি এবং প্রায় ছয় হাজার ক্যাথ করা হয়েছে। হাসপাতালে চালু হওয়া পৃথক চারটি ইউনিটে শিশুদের জন্য সাধারণ ২৮ ও আইসিইউর চারটি শয্যা রয়েছে। তবে পৃথক ক্যাথল্যাব নেই। বড়দের ল্যাবটি মাসে চার দিন শিশুদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। তাতে সর্বোচ্চ ৩০ জনের ডিভাইস পরানো যায়। পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগে ওপেন হার্ট সার্জারি ও হার্টের বাল্ব প্রতিস্থাপনের জন্য শিশুদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কাজী আবুল হাসান বলেন, শিশুদের ওপেন হার্ট সার্জারি ও হার্টের বাল্ব প্রতিস্থাপন অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়। তাই একটি ইউনিটে দিনে একজন শিশু রোগীর বেশি অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হয় না। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যে দুটি প্রতিষ্ঠানে এ চিকিৎসা দেওয়া হয় তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। দরিদ্র রোগীদের পক্ষে সেখানে চিকিৎসা নেওয়া দুরূহ। তাই সরকারি পর্যায়ে এ চিকিৎসা সম্প্রসারণের বিকল্প নেই।

ঢাকা শিশু হাসপাতালে ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৩৩৫ শিশু ইনডোরে জন্মগত হৃদরোগের চিকিৎসা নিয়েছে। একই সঙ্গে দুই বছরে কার্ডিয়াক সার্জারি ১৮৯, ওপিডি ২ হাজার ৭৫২, ইকো-কার্ডিওগ্রাম ৯ হাজার ৮৭৪ ও কার্ডিয়াক ক্যাথল্যাব করা হয়েছে ২৯৪ জনের। এখানকার পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আবু সাঈদ মুন্সী বলেন, ২০০৯ সালে শিশু হাসপাতালে শিশু হৃদরোগ বিভাগ চালু হয়। প্রতি বছরই রোগীর চাপ বাড়ছে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৩৫-৪০ জন চিকিৎসা নিতে আসে। কার্ডিওলজি ও সার্জারি মিলে ২৮টি শয্যা সব সময়ই পূর্ণ থাকে।

রাজধানীর মিরপুরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তলায় নারী ও শিশু হৃদরোগীদের জন্য দেড়শ' শয্যাবিশিষ্ট কার্ডিয়াক ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এ কে শামসুদ্দিন বলেন, দেড়শ' শয্যা প্রতিষ্ঠা করা হলেও একশ'র কিছু কম শয্যা চিকিৎসা উপযোগী করা হয়েছে। রোগীর ভিড় সামলাতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে শিশু হৃদরোগ চিকিৎসায় রয়েছে মাত্র আটটি শয্যা। হাসপাতালটির শিশু কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রোকনুজ্জামান সেলিম বলেন, সপ্তাহে চারজন জন্মগত হৃদরোগীর অস্ত্রোপচার করা হয়। তিনি জানান, কার্ডিয়াক সার্জারিতে পাঁচ ও কার্ডিওলজিতে ১১ চিকিৎসক দিয়ে দেশের হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা চলছে। রাজধানীর বাইরে কোথাও চিকিৎসা নেই। তাই চিকিৎসা সম্প্রসারণে সরকারের জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সমকালকে বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য বিশ্বজুড়ে অসংক্রামক ব্যাধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এরই মধ্যে হৃদরোগের চিকিৎসায় সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। এনআইসিভিডিতে নতুন যন্ত্রপাতির পাশাপাশি শয্যাসংখ্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশের সব মেডিকেল কলেজে কার্ডিওলজি বিভাগ ও পৃথক শিশু কার্ডিওলজি ইউনিট খোলার বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।

http://bangla.samakal.net/2017/03/22/279100#sthash.n1Eb6DrQ.dpuf