২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার, ১০:৩৩

সেকেন্ড ওয়েবে উৎকণ্ঠায় যারা

দুই বছর আগে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ছেলের পরিবারের সঙ্গে থাকছেন সালাম খান। স্ত্রী মারা গেছেন ১০ বছর আগে। সম্প্রতি খাবার নিয়ে কথা বলায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন সালাম। সালামের প্রতিবেশী বলেন, কোরবানির ঈদের পর থেকে তার মানসিক পরিবর্তন দেখা দেয়। কোনো কথা সে ইতিবাচকভাবে নিতে পারতেন না। সম্প্রতি ছেলের বউয়ের সঙ্গে অভিমান করে ফজরের নামাজ শেষে বাসায় ফিরে মই দিয়ে গাছে উঠে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। সালামের পুত্রবধূ বলেন, করোনা শুরু হওয়ার পর থেকেই তিনি হঠাৎ বদলে যান। আমরা ওনাকে পাহারা দিয়ে বাসায় রাখতাম।

লকাডাউন শেষে ওনার এই মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। সামান্য কথায় শিশুদের মতো অভিমান করতেন।

ইলমার বয়স ৮ বছর। বয়সের তুলনায় শারীরিকভাবে অনেক বড় হয়ে গেছে। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ইলমার মা একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে চাকরি করেন। মায়ের চাকরির সুবাদে নানা-নানির সঙ্গে ইলমা ফরিদপুরে থাকেন। সম্প্রতি তার শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেয়। একই সঙ্গে কিছু মনে রাখতে পারেনা। নিজের নামও ভুলে যায়। ভুল করে অন্যের রুমে চলে যায়। যাকে সামনে পায় তাকেই জানতে চায়, আচ্ছা আমার নাম কি। ইলমার মা বলেন, ইলমাকে বারবার তার নাম মনে করিয়ে দিতে হয়। একটু পরপর বলে, আম্মু আমি কোন ক্লাসে পড়ি? তাছাড়া কাউকে দেখলেই প্রচণ্ড ভয় পায়। কারণে অকারণে ভয় পায়। মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়েছিলাম। চিকিৎসক বলেছেন, দীর্ঘদিন বাসায় বদ্ধ পরিবেশে থেকে তার মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। একইসঙ্গে তার হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে।

২০১৯ সালে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন শাহজাহান। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকেন সাভারের বিশ মাইল এলাকায়। ছেলের চাকরির সুবাদে সরকারি বাসভবনে থাকছেন এখনো। বাসার পেছনে রয়েছে তার ছোট্ট সবজি বাগান। আখ, লেবু, পেয়ারা থেকে শুরু করে অনেক ধরনের গাছ রয়েছে তার বাগানে। করোনার প্রথমদিকে দিনের অধিকাংশ সময় বাগান পরিচর্যায় ব্যয় করেছেন। কিন্তু সম্প্রতি তার বাগানের কাজে মন নেই। প্রায়সই বুকের ভেতর এক ধরনের চাপ অনুভব করেন। শাহজাহান বলেন, মনে হয় কিছু একটা বুকে চেপে বসে আছে। ইদানীং একটু জোরে হাটলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। কিছুই ভালো লাগেনা। নাতী-নাতনীদের সঙ্গে সময় কাটাতেও যেনো এখন খুব বিরক্ত লাগে। করোনা ভীতি কমেছে। তবে একটা অজানা আতঙ্ক অজান্তে মনে বয়ে বেড়াচ্ছি। সেটা কি? নিজেও জানি না।

বুলবুল হোসেন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। বয়স ৫২ বছর। করোনার লকডাউনের সময়ে প্রথম এক মাস বাসায় বসে নামাজ পড়লেও তারপর থেকে চুপিসারে মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন। সবার আগে গিয়ে মসজিদে হাজির হতেন। বুলবুল জানান, করোনা বলতে কিছু নেই। পাঁচ ওয়াক্ত ওজুর সঙ্গে করোনার জীবানু পানির সঙ্গে চলে যায়। এটা ইমানের পরীক্ষা। মসজিদে কেনো মুসল্লিরা ফাঁকা হয়ে নামাজে দাঁড়ায় এখনো? জনে জনে তার উত্তর খুঁজে বেড়ান বুলবুল। পরিবারের সদস্যরা প্রথমদিকে তাকে অনুরোধ করে ফেরাতে পারলেও এখন সে কারো কথা শোনেন না। যখন যেখানে খুশি চলে যান। তার মেয়ে বলেন, সম্প্রতি মাত্রাতিরিক্ত কথা বলেন। বিনা প্রয়োজনে কথা বলেন। যখন তখন বাইরে চলে যান। বাসায় একদম থাকেন না। তার একটিই কথা, করোনা কোনো রোগ না। এটি একটি পরীক্ষা। যার ঈমান মজবুত তাকে করোনা আক্রান্ত করবেনা।

করোনার মহামারির কারণে আমাদের জীবনে যেসব পরিবর্তন ঘটেছে, তাতে মানসিক উৎকণ্ঠা অনেক বেড়ে গেছে। বয়স্করা কেউ কেউ মানসিক উৎকণ্ঠায় ভুগছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটা মানসিক চাপ বা কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত হওয়ার চাইতে বেশি কিছু। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেউ যখন সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকেন সেটা রীতিমত ভীতিকর হয়ে উঠে। যেটা থেকে সহজে মুক্তি মেলেনা তখন সেটাকেই মানসিক উৎকণ্ঠা বা দুশ্চিন্তা বলা হয়। মানসিক উৎকণ্ঠার অনেক রকম ফের আছে। কারো ক্ষেত্রে খুবই মৃদু। কারো ক্ষেত্রে এটি খুবই তীব্র হয়ে উঠতে পারে। করোনার এই সময়ে শিশুরাও মারাত্মক মানসিক দুশ্চিন্তায় ভোগে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, এই সময়ে বয়স্করা মানসিকভাবে বিপদগ্রস্ত। পরিবারের সদস্যরা যদি লক্ষ্য করেন যে সব কিছু থেকে আগ্রহ হারিয়ে তারা এক ধরনের বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন শুরু করেছেন। নিজের মাঝে আবদ্ধ আছেন। তখন এটা ঝুঁকিতে পরিণত হয়।

এক্ষেত্রে বয়স্কদের ক্ষেত্রে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণহীনতা। অর্থাৎ আমার কিছু করার নেই। যেকোনো সময় করোনা আক্রান্ত হতে পারি এবং আমি মারা যাবো। বয়স্কদের মাঝে এই মারা যাওয়ার ভীতিটা খুব বেশি মাত্রায় আছে। এর মধ্যে তাদেরকে যদি আরো অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কষ্ট দেয়া হয়। ফলে তারা জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। পরিসংখ্যানে তাই দেখা যাচ্ছে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ যারা মারা যাচ্ছেন তাদের ৫০ উর্ধ্ব বয়স।

বয়স্কদের ক্ষেত্রে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করে। এটা যৌক্তিকভাবেই আছে। ভয়টা সবার মধ্যে আছে। তবে বয়স্কদের মধ্যে মৃত্যু ঝুঁকিটা বেশি। এই উৎকণ্ঠা বা আতঙ্ক যদি বেশি মাত্রায় চলে যায় এবং আত্মহত্যার মতো ঝুঁকি তৈরি হয়। তীব্রমাত্রার আতঙ্ক তৈরি হলে বা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে সেক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা যদি বিষয়টি লক্ষ্য করেন তাহলে যতো দ্রুত সম্ভব তাকে মানসিক সাপোর্ট বা সঙ্গ দেয়াটা খুব জরুরি। কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ইতিবাচকভাবে সমর্থন করা এবং প্রয়োজনে একজন পেশাদার মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রয়োজনে সাইকো থেরাপি বা কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

শিশুরা করোনার বিষয়টি ওভাবে বুঝে উঠতে পারছে না। তাদের মধ্যে করোনা ভীতি অতোটা নেই। তাদের মূল সমস্যা হচ্ছে বাসায় বন্দি থাকা। আগে নিয়মিত স্কুলে যাওয়া হতো সেটা যেহেতু বন্ধ। ফলে তাদের জীবন আরো বেশি আবদ্ধ হয়ে আছে। তাদেরকে বাবা-মায়ের সঙ্গে বেশি থাকতে হচ্ছে এবং বাব-মা হয়তো অনেক ধরনের যৌক্তিক বা অযৌক্তিক শাসন করছেন। যেটাতে তারা আরো ভেঙ্গে পড়ছে। এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের উচিৎ শিশুদের মানসিকতা বুঝে আচরণ করা। প্রয়োজনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে তাদের জন্য খেলাধূলা বা ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটির ব্যবস্থা করা। শহর এলাকায় বাসার ছাদে, পার্কে হাটার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শুধু পড়ালেখার মধ্যে থাকলে এক সময় ধৈর্য হারিয়ে অপছন্দের কাজগুলো করতে শুরু করবে। প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে।

https://www.mzamin.com/article.php?mzamin=244453&cat=3