২২ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ৮:৫৯

মানহীন পানি জারে ভরলেই বিশুদ্ধ!

রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠা পানি সরবরাহ কোম্পানিগুলো বিশুদ্ধ নামে মানহীন পানি বাজারজাত করছে। কেউ ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে মেডিসিন ব্যবহার করে, কেউ অগভীর নলকূপের পানি সরাসরি জারে ভরে বাজারজাত করছে। প্রতিদিন পানিভর্তি হাজার হাজার জার বিভিন্ন অফিস, দোকান, রেস্টুরেন্ট ও আবাসিক হোটেলে সরবরাহ করছে। এ পানি পান করে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। প্রকাশ্যে দুর্গন্ধযুক্ত ও মানহীন পানির রমরমা বাণিজ্য চললেও এসব নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর কার্যকর তৎপরতা নেই।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন যুগান্তরকে বলেন, মানহীন পানিসহ খাদ্যসামগ্রী বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করতে ডিএসসিসির পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব অভিযানে মানহীন পানি উৎপাদন কারখানাকে জেল-জরিমানা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক যুগান্তরকে বলেন, শুধু মানহীন পানি নয়, খাদ্যের সামগ্রিক ভেজাল বন্ধ করতে ডিএনসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এসব অভিযানের আওতায় মানহীন পানি পেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে এক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত সব সংস্থাকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান ডিএনসিসি মেয়র।
জানা গেছে, ঢাকা ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ থাকায় নগরবাসীর অনেকেই বাসাবাড়িতে জারের পানি কিনে খাচ্ছেন। এছাড়া রাস্তার ফুটপাতে গড়ে ওঠা চায়ের দোকানগুলোয়ও এক গ্লাস পানি এক টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ, স্কুল-কলেজ, বেকারি, ফাস্টফুডের দোকান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চাহিদামতো জারের পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। নামে-বেনামে মানহীন পানি জারে ভরে বিক্রি করছে ব্যবসায়ী নামধারী প্রতারক চক্র।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, নামসর্বস্ব কোম্পানিগুলো পানি শোধন না করেই বাজারজাত করছে। পানি প্রতারকরা ঢাকা ওয়াসার দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে ফিটকিরি ও দুর্গন্ধ দূর করার ট্যাবলেট মিশিয়ে জারে ভরছে। পরে বাজারজাত করছে। মাত্র কয়েকটি কোম্পানি মোটরের সাহায্যে পানি তুলে সরাসরি জারে ভরে বাজারজাত করছে।
বাংলাদেশ পিওর ড্রিংকিং ওয়াটার ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, রাজধানীতে বৈধ পানি তৈরির কারখানা অর্ধশত। আর বাস্তবে পানির ব্যবসা পরিচালনা করছে শতাধিক কোম্পানি। বিএসটিআইয়ের তথ্যমতে, সারা দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত পানি উৎপাদন কারখানার সংখ্যা ২৬০টি। এর মধ্যে রাজধানী এবং আশপাশের এলাকায় রয়েছে শতাধিক। ঢাকা ওয়াসার তথ্যমতে, ৩৫টি পানি উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের ওয়াসার পানি ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে।
খোঁজখবরে জানা যায়, মোহাম্মদপুরের বছিলা, ঢাকা উদ্যান, চাঁদমিয়া হাউজিং এলাকায় ১০-১২টি জারপানি সরবরাহ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই কোনো অনুমোদন নেই। ওই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পানি উৎপাদন মেশিন, ল্যাবরেটরি, ক্যামিস্ট কিছুই নেই। বছিলা এলাকার একটি পানি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তারা পানি সংগ্রহ করে অন্যত্র বিক্রি করেন।
এ প্রসঙ্গে বিএসটিআইয়ের ডেপুটি ডিরেক্টর নুরুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় জার পানি বিক্রির নামে অবৈধ পানির ব্যবসা চলছে। বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে জেল-জরিমানা ও সিলগালা করে দেয়ার পরও তাদের থামানো যাচ্ছে না। কেননা এসব অবৈধ জারপানি কোম্পানিগুলো পরিচালিত হচ্ছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়।
মঙ্গলবার সকালে আল্লাহ করিম মসজিদ থেকে বেড়িবাঁধ পর্যন্ত সংযোগ সড়কের বাঁশবাড়ি সড়কের প্রবেশমুখে একটি খাবারের হোটেলের দোকানের সমানে ২৫-৩০টি ছোট আকৃতির পানিরজার লক্ষ করা যায়। ওই পানির জারগুলোয় কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা নেই। রং উঠে ধূসর আকৃতি ধারণ করেছে। পানির ভালো-মন্দ মান বিচার না করেই মানুষ ওই পানি খাচ্ছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হোটেলবয় আবদুর রহমান জানান, বছিলার একটি পানির ফ্যাক্টরি থেকে একজন পানি এনে দিয়ে যায়, কোম্পানির নাম কী, সেটা জানি না। তবে যে লোক পানি দিয়ে যান তার নাম ওমর আলী।
হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ সংলগ্ন কোম্পানিঘাট বাজারের বিভিন্ন দোকানে ভ্যানগাড়িতে করে পানি সরবরাহ করেন মোতালেব হোসেন। শনিবার কথা হয় তার সঙ্গে। যুগান্তরকে বলেন, কামরাঙ্গীরচরের রহমতবাগের একটি পানির ফ্যাক্টরি থেকে পানি কিনে এনে বিক্রি করেন তিনি। সেখানে কীভাবে পানি উৎপাদন হচ্ছে, তা তিনি জানেন না। তার সরবরাহকৃত জার পানির কোনো নামও নেই।
পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা ওয়াসা রাজধানীবাসীর বিশুদ্ধ পানির চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় জারপানির ব্যবসা গড়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে ঢাকা ওয়াসার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাই পারে মানহীন জার বা বোতলের পানি-বাণিজ্য বন্ধ করতে।
এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ। এ মান নিয়ে মন্তব্য করার কোনো সুযোগ নেই। তবে সরাসরি তো এসব পানি পান করা যাবে না। প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বাজারজাত করতে হবে বা খেতে হবে। এটা যারা করছেন, তারা অন্যায় করছেন। এটা দেখা আমাদের দায়িত্ব না।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/03/22/111078/