১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার, ২:০৫

নেপথ্যে চার কারণ ট্রাক সেল আজ থেকে

কারসাজির চোরাবালিতে পিয়াজের দাম

আবারো অস্থির পিয়াজের বাজার। বাজারে পর্যাপ্ত পিয়াজ থাকা সত্ত্বেও পণ্যটির দাম হু হু করে বাড়ছে। পণ্যটি নিয়ে চলছে কারসাজির চেষ্টা। পিয়াজের হঠাৎ করে মূল্যবৃদ্ধির জন্য ভারতীয় পিয়াজ আমদানি কম এবং সে দেশে মূল্য বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া বাংলাদেশের মাওয়া ঘাটে ফেরি পারাপার বন্ধ থাকা- এই তিন অজুহাতে ব্যবসায়ীরা পিয়াজের দাম বাড়াচ্ছেন। এর পেছনে আমদানি-কারকরা জড়িত বলে খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ। গত এক সপ্তাহে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেড়েছে। রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিন্ডিকেটকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় তারা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছে। এতে ভোক্তাদের ওপর চাপ বাড়ছে। এদিকে দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে পিয়াজের দাম স্থলবন্দরের আমদানিকারকরা নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। স্থলবন্দর থেকে এক দামে পিয়াজ কিনে খাতুনগঞ্জে পাঠান তারা। ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হওয়া পিয়াজের সরবরাহের হার, মজুত এবং খাতুনগঞ্জের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে তারা আড়তদারদের দাম নির্ধারণ করে দেন।

পিয়াজ উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, পাইকার ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে পিয়াজের কোনো সংকট নেই। পর্যাপ্ত পরিমাণে দেশি জাতের পিয়াজ বিভিন্ন স্থানে মজুত রয়েছে। অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ীর কাছেও পিয়াজ মজুত রয়েছে। ভারত থেকে আমদানি কমে যাওয়া এবং সেখানে মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ নিচ্ছেন দেশের ব্যবসায়ীরা।

সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবিও বলছে, গত এক মাসে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পিয়াজের দাম। সংস্থাটির হিসাবে গত এক মাসে দেশি পিয়াজের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশ। আর আমদানি করা পিয়াজের দাম বেড়েছে ৭২ শতাংশ।

বাজারে পিয়াজের দাম বাড়ার বিষয়টি এখন ক্রেতাদের মুখেমুখে। কারণ, পিয়াজের দাম নিয়ে গত বছরের অস্বস্তি এখনো ক্রেতাদের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। সে সময় ভারত পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় বাজারে পিয়াজের সরবরাহ কমে যায়। ফলে প্রতি কেজি পিয়াজের দাম প্রায় ৩০০ টাকায় উঠে যায়। যা নিয়ে সারা দেশে রীতিমতো তোলপাড় শুরু হয়। এ ছাড়া সরকারের অনুরোধে দেশের ৩টি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে পিয়াজ আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়। এর পরও সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। এখন আবার নতুন করে পিয়াজের দাম বাড়ায় আগের সেই আতঙ্ক কাজ করছে ক্রেতাদের মধ্যে।

রাজধানীর কাওরান বাজার, মগবাজারসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক মাস আগে প্রতিকেজি পিয়াজের দাম ছিল ৩০ টাকা। এখন সেই পিয়াজ গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়। আর একই সময়ে প্রতিকেজি আমদানি করা পিয়াজের দাম বেড়েছে ৩০ টাকা, যা এখনো বাজারে আসেই নাই।

সূত্র জানায়, আমদানিকারকদের কারসাজিতে কয়েক দিনের ব্যবধানে চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে পিয়াজের দাম ঠেকেছে ৫০ টাকা পর্যন্ত। এভাবেই হুটহাট দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন কিছু আমদানিকারক। শুধু ফোনে দাম নির্ধারণ করে খাতুনগঞ্জের পিয়াজের বাজার অস্থির করার পেছনে আমদানিকারকদের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে জেলা প্রশাসন।

কাওরান বাজারে পাইকারি দোকানে ৪ ধরনের দেশি পিয়াজ রয়েছে। রাজশাহী ও পাবনার দেশি পিয়াজের দাম ৬২ থেকে ৬৪ টাকা কেজি। ফরিদপুরের দেশি জাতের পিয়াজের কেজি ৫৬ থেকে ৫৮ টাকা। কিং নামের একটি জাতের দেশি পিয়াজের কেজি ৫৪ থেকে ৫৬ টাকা। আর ভারতীয় বড় পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪৬ টাকা কেজি।

কাওরান বাজারের বিক্রেতা আক্তার হোসেন বলেন, এক সপ্তাহ ধরেই বাজার একটু বাড়তি ছিল। গত দুইদিনে বেশি বেড়েছে।

রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এলাকা ভেদে কোথাও কোথাও ৮০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। আর আমদানিকৃত পিয়াজ ৪৫ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হয়। কয়েকদিন আগে যা যথাক্রমে ৪০ থেকে ৪৫ ও ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

কাওরান বাজারের ব্যবসায়ী আবুল হোসেন বলছেন, ভারতীয় পিয়াজের দাম বাড়লে দেশি পিয়াজের দামও বাড়ে। আমরা আমদানিকারক বা শ্যামবাজার থেকে পিয়াজ এনে বিক্রি করি। সেখানে যে টাকায় পাবো, তার সঙ্গে সামান্য লাভ যোগ করে পাইকারি বিক্রি করি।

ঢাকার হাতিরপুল এলাকার বাসিন্দা নাজমা আক্তার বলেন, সকালে ৬০ টাকা দরে পাঁচ কেজি পিয়াজ কিনেছি। সাধারণত দুই কেজি করে কিনি। কিন্তু গত বছরের মতো আবার দাম বেড়ে ৩০০ টাকা পার হয়ে যায় কিনা, সেই ভয়ে বেশি করে পিয়াজ কিনলাম।

পিয়াজের দাম শিগগিরই নিয়ন্ত্রণে আসবে জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, পিয়াজ আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্ক কমানো হচ্ছে। এছাড়া দামবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পিয়াজের মজুত ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে চলতি বছর সর্বোচ্চ পরিমাণ পিয়াজ আমদানি করা হবে। এর ফলে শিগগিরই দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে।

হঠাৎ পিয়াজের দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে আমদানিকারকদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সি-বার্ড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী রতন সাহা বলেন, ভারতে অতি বৃষ্টির কারণে উত্তর প্রদেশ থেকে পিয়াজ আমদানি কম হচ্ছে।

করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় ক্রয়ক্ষমতাও কমে গেছে। এ অবস্থায় পিয়াজ, চাল ও ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজিউমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, করোনার কারণে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের আয় কমে গেছে। অথচ এখন বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের কষ্ট বেড়ে যাচ্ছে। এদিকে সরকারের নজর দেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।

কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, বাংলাদেশে গত মৌসুমে সাড়ে ২৫ লাখ টন পিয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। দেশে বর্তমানে ২৩ লাখ টন পিয়াজ উৎপাদন হয়। অবশ্য উৎপাদন ও চাহিদার হিসাব নিয়ে নানা বিভ্রান্তি রয়েছে। আমদানি হওয়া পিয়াজের প্রায় ৯৫ শতাংশ আসে ভারত থেকে। আর পিয়াজ ঘরে তোলার সময় প্রায় ৫ লাখ টন নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ ১৯ লাখ টন পিয়াজ বাজারে থাকে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে আমদানি হয় ১১ লাখ টন। সেই হিসাবে দেশে প্রতিবছর ৩০ লাখ টন পিয়াজ প্রয়োজন।

আজ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে পিয়াজ বিক্রি করবে টিসিবি
আজ রোববার থেকে সারা দেশে ২৭৫টি ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ৩০ টাকা কেজি দরে পিয়াজ বিক্রি করবে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। আগামী ১লা অক্টোবর পর্যন্ত শুক্র ও শনিবার বাদে প্রতিদিন এই দামে পিয়াজ বিক্রি করবে সংস্থাটি। টিসিবির এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই কেজি করে পিয়াজ কিনতে পারবেন। এছাড়া একজন ক্রেতা চিনি ও মশুর ডাল ৫০ টাকা কেজি দরে সর্বোচ্চ ২ কেজি এবং সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ৮০ টাকা দরে দুই লিটার থেকে ৫ লিটার কিনতে পারবেন। টিসিবি জানিয়েছে, বর্তমান করোনাভাইরাস এবং বন্যা পরবর্তী পরিস্থিতিতে ঢাকায় ৪০টি, চট্টগ্রামে ১০টি, রংপুরে ৭টি, ময়মনসিংহে ৫টি, রাজশাহীতে ৫টি, খুলনায় ৫টি, বরিশালে ৫টি, সিলেটে ৫টি, বগুড়ায় ৫টি, কুমিল্লায় ৫টি, ঝিনাইদহে ৩টি ও মাদারীপুরে ৩টি করে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে পণ্য বিক্রি করা হবে। এ ছাড়া বাকি জেলাগুলোর (উপজেলায়সহ) প্রতিটিতে দু’টি করে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে পণ্য বিক্রি করা করবে টিসিবি। প্রতিটি ট্রাকে চিনি ৫০০-৭০০ কেজি, মশুর ডাল ৪০০-৬০০ কেজি, সয়াবিন তেল ৭০০ থেকে ১ হাজার লিটার ও পিয়াজ ২০০ থেকে ৪০০ কেজি বরাদ্দ থাকবে বলে জানায় টিসিবি।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=242631&cat=2