২২ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ৮:৪৪

ডুবতে বসেছে সোনালী ব্যাংক ইউকে শাখা : তবুও ১৭৮ কোটি টাকার জোগান

ডুবতে বসছে সোনালী ব্যাংকের ইউকে শাখা। নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির কারণে সঙ্কোচিত হয়ে পড়েছে এর ব্যবসা কার্যক্রম। ছয় মাসের জন্য আমানত সংগ্রহে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ওপর। গুনতে হচ্ছে বড় অঙ্কের জরিমানা। প্রতিনিয়তই লোকসান গুনতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতেও সোনালী ব্যাংক ইউকে শাখার জন্য ১৭৮ কোটি টাকার অর্থের জোগান দিয়েছে সরকার। সোনালী ব্যাংক থেকে আরো ১৭১ কোটি টাকা পাঠানোর জন্য অনুমোদন চাওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। সোনালী ব্যাংকের এক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের ফাইন্যান্সিয়াল কনডাক্ট অথোরিটি (এফসিএ) ও প্রুডেনশিয়াল রেগুলেটরি অথোরিটি (পিআরএ থেকে মানিলন্ডারিং আইন পরিপালন না করায় এবং অনিয়ম দূরীকরণে শর্ত বাস্তবায়ন না করায় সোনালী ব্যাংক ইউকে শাখাকে সম্প্রতি ১৮০ দিন অর্থাৎ ছয় মাসের জন্য কোনো প্রকার আমানত নেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। একই সাথে ৪৪ লাখ পাউন্ড, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৪৪ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। কিন্তু সোনালী ব্যাংক কিছু নির্দেশনা এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করায় জরিমানার পরিমাণ কমিয়ে ৩২ কোটি টাকা করা হয়েছে। আর আমানত নেয়ার নিষেধাজ্ঞা ১৮০ দিন থেকে কমিয়ে ১৬৮ দিনে নামিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু জরিমানার অর্থ পরিশোধ এবং আমানত নেয়ার নিষেধাজ্ঞা ১৬৮ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও ব্যবসা সম্প্রসারণের তেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই বলে জানায় সোনালী ব্যাংক সূত্র। কারণ, পূর্বে দেয়া বিভিন্ন শর্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হলেই কেবল ব্যবসা সম্প্রসারণে অর্থাৎ আমানত সংগ্রহের অনুমোদন পাওয়া যাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আমানত সংগ্রহে নিষেধাজ্ঞা ধাকায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক কার্যক্রম দিন দিন কমে যাচ্ছে। বর্তমানে শুধু কিছু বন্ড কেনাবেচার মধ্যেই সীমিত থাকতে হচ্ছে। ফলে সোনালী ব্যাংক ইউকে শাখা চালু রাখতে এখন প্রতিদিনই বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে।
এ দিকে কার্যক্রম টিকিয়ে রাখতে যুক্তরাজ্যের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পরিপালনে অর্থ সঙ্কটে পড়ে সোনালী ইউকে শাখা। এর ফলে সোনালী ব্যাংক মাত্র শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে ৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার ডিপোজিট রাখে সোনালী ইউকে শাখার কাছে। এ অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় ৭০৪ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংকের ইউকে শাখা একটি সাবসিডিয়ারি বা সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানে সোনালী ব্যাংকের ৪৯ শতাংশ শেয়ার এবং সরকারের ৫১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। অর্থ সঙ্কট মেটাতে সোনালী ব্যাংক ডিপোজিট রাখার পাশাপাশি সোনালী ইউকে শাখার সাথে রক্ষিত সোনালী ব্যাংকের নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে সাড়ে ৫ কোটি ডলার রাখে, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক ইউকে শাখার ব্যবসা-কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রমে সোনালী ব্যাংকের পুরো অর্থই এখন ঝুঁকির মুখে। এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সোনালী ইউকে শাখায় থাকা প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা দেশে বিনিয়োগ করলে বছরে গড়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকা মুনাফা পাওয়া যেত। কিন্তু এখন তারা পাচ্ছে মাত্র ৮ কোটি টাকা। ফলে বছরে তাদের এ কারণে সম্ভাব্য লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রায় ৯২ কোটি টাকা। তাছাড়া এ অর্থ আদৌ ফেরত পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সোনালী ব্যাংকের ইউকে শাখার কার্যক্রম চালু রাখতে হলে তাদের অর্থের জোগান দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানার হার অনুসারে মূলধন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে তাদের অংশ অর্থাৎ ১৭৮ কোটি টাকার জোগান দেয়া হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের অংশ অর্থাৎ ১৭১ কোটি টাকার জোগান দেয়ার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে অর্থ পাঠানোর অনুমোদন চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে সোনালী ব্যাংকের ইউকে শাখা। ২০১৩ সালের ২ জুন সোনালী ব্যাংক ইউকের ওল্ডহ্যাম শাখা থেকে সুইফট কোড জালিয়াতির মাধ্যমে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার (প্রায় ২ কোটি টাকা) হাতিয়ে নেয়া হয়। এই অর্থ এখনো আদায় করতে পারেনি ব্যাংকটি। অভিযোগ রয়েছে, ওল্ডহ্যাম শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক ইকবাল আহমেদ ব্যাংকের ভল্ট থেকে অর্থ চুরি, গ্রাহকের হিসাব থেকে অবৈধভাবে অর্থ উত্তোলন ও গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নেন। এভাবে অর্থ হাতিয়ে নেয়ায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ স্থানীয় পুলিশকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর বন্ধ হয়ে যায় শাখাটি। ওল্ডহ্যাম শাখা বন্ধের পর গত ৩০ জুন বন্ধ করে দেয়া হয় লুটন শাখা। এরপর গত ৩০ সেপ্টেম্বর বন্ধ হয়ে গেছে কেমডেন শাখাও। নানা অনিয়মের কারণে একের পর এক যখন বন্ধ হচ্ছে বিভিন্ন শাখা, তখন নতুন করে অর্থের জোগান দিয়ে তা আদৌ ফেরত আসবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। লুটপাট-অনিয়মের বিষয় ক্ষতিয়ে দেখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি টিম যুক্তরাজ্য গিয়েছিল। ওই টিমের রিপোর্ট এখন পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এতে সন্তুষ্ট হলেই কেবল সোনালী ব্যাংকের নতুন করে অর্থ পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে।
২০০১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যে যাত্রা শুরু করে সোনালী ব্যাংক। প্রবসীদের সেবা ও বৈদেশিক বাণিজ্য নিশ্চিত করতে ওই সময় এর অনুমোদন দেয়া হয়েছিল।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/205708