২১ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৩৩

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল

‘ঘুষ’ না দেওয়ায় ৩৭৯ নার্সের বেতন বন্ধ!

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর যোগদান করেছেন ৩৭৯ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স। চাকরির বয়স এরই মধ্যে তিন মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো বেতন পাননি দ্বিতীয় শ্রেণি পদমর্যাদার এসব কর্মকর্তা। কখন বেতন মিলবে তাও অনিশ্চিত। এ অবস্থায় কর্মরত নার্সদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, ঘুষ না দেওয়ায় নতুন নিয়োগ পাওয়া এসব নার্সের বেতন আটকে আছে। আর সেই ঘুষের টাকা জোগাতে বেতন না পেয়ে নানামুখী সমস্যায় থাকা নার্সদের কাছ থেকে গণহারে চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। জনপ্রতি ৭০০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। হিসাবরক্ষণ কার্যালয় ও হাসপাতালের হিসাব বিভাগকে ম্যানেজ করার নামে হাসপাতালে ডিপ্লোমা নার্সিং অ্যাসোসিয়েশনের কয়েকজন নেতার তত্ত্বাবধানে এই চাঁদা আদায় চলছে।
অন্যদিকে নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে যাঁরা বদলি হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে যাচ্ছেন, তাঁদেরও ছাড়পত্র নিতে ঘুষ দিতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জনপ্রতি ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে।
চাঁদা উত্তোলনকারীদের একজন (নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত) নাম প্রকাশ না করে কালের কণ্ঠকে বলেন, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত সবাই যাতে বেতন পান সে জন্য একটি তহবিল গঠন করা হচ্ছে। প্রত্যেকের ৭০০ টাকা চাঁদা ধার্য করা হয়েছে। সেই হিসাবে দুই লাখ ৬৫ হাজার ৩০০ টাকা উত্তোলন করা হবে। এরই মধ্যে প্রায় দুই শ জন টাকা দিয়েছেন। অন্যরাও এই সপ্তাহের মধ্যে টাকা দেবেন।
চট্টগ্রামের ডিভিশনাল কন্ট্রোলার অব অ্যাকাউন্টস কার্যালয়ের অডিট ও অ্যাকাউন্টস অফিসার এ বি এম গোলাম আহাদ এ ব্যাপারে রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডিসেম্বরের মাঝামাঝি যোগদান করলে তাঁদের প্রথম বেতন জানুয়ারি মাসে হওয়ার কথা। জানুয়ারিতে না পেলে অবশ্যই ফেব্রুয়ারিতে পাবেন। কিন্তু এত দিন লাগার কথা নয়। নতুন নিয়োগ পাওয়া সিনিয়র স্টাফ নার্সদের বেতন নির্ধারণসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ও বিল এখনো আমাদের (এজি অফিস) কাছে আসেনি। কেন দেরি হচ্ছে তা হাসপাতালের হিসাব বিভাগ বলতে পারবে। ’ তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে নিয়োগ ও যোগদানপত্র, বয়স নির্ণয়ের জন্য এসএসসির সার্টিফিকেট, বেতন নির্ধারণসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আমাদের কাছে পাঠালে তা যাচাই-বাছাই করে বেতন নির্ধারণ করে বিল পাস করা হয়। ৩৭৯ জন হলে এই কাজ করতে আমাদের সপ্তাহখানেক লাগবে। কিন্তু এখানে তো এসংক্রান্ত কোনো ফাইলই আসেনি। ’
চমেক হাসপাতালের উপপরিচালক মোহাম্মদ দিদার উল ইসলাম বলেন, ‘প্রথম বেতন হতে একটু সময় লাগছে, প্রসেসিং চলছে। চাঁদা উত্তোলনের বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। এ ব্যাপারে নার্সিং অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকের কাছে জানতে পারেন। এ নিয়ে কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ করলে তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
জানতে চাইলে ডিপ্লোমা নার্সিং অ্যাসোসিয়েশন চমেক হাসপাতাল শাখার সাধারণ সম্পাদক তপন কান্তি দে বলেন, ‘বেতনের জন্য জনপ্রতি ৭০০ টাকা করে তাঁরা (নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত সিনিয়র স্টাফ নার্স) তুলছেন। আমি এর সঙ্গে জড়িত নই। তবে প্রথম বেতনের জন্য টাকা লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু না। আমরা যখন চাকরি পাই তখন আমাদেরকেও টাকা দিতে হয়েছে। ’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে চট্টগ্রামে কম নেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য হাসপাতালে আরো অনেক বেশি নিচ্ছে। দুই-তিন হাজার টাকাও নিচ্ছে কোনো কোনো হাসপাতালে। আশা করি এপ্রিলের ৪-৫ তারিখে বেতন হয়ে যাবে। ’
নতুন চাকরি পাওয়াদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। হাসপাতালের ১১বি, ২৬ নম্বর, অপারেশন থিয়েটারসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে কর্মরত নার্সরা নাম প্রকাশ না করে জানান, চাকরি পেয়ে নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে যোগদান করার পর বাসা না পেয়ে হাসপাতালের নার্সিং স্টাফ হোস্টেলে উঠেছেন অনেকে। দুই-তিনজন ধারণক্ষমতার একেকটি রুমে থাকতে হচ্ছে পাঁচ-ছয়জন করে। এখন ১১৭ জন নার্স হোস্টেলে আছেন। বেতন না হওয়ায় তাঁরা বাইরে বাসা ভাড়া নিতে পারছেন না। সাড়ে তিন মাস পেরিয়ে গেলেও কখন বেতন হবে তা তাঁরা জানেন না। অর্থাভাবে অনেকে ধার্যকৃত ৭০০ টাকাও দিতে পারেননি। আবার বলা হচ্ছে, টাকা না দিলে বেতন হবে না।
এদিকে নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে ৪০ জনের বেশি দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বদলি হয়েছেন। আরো বেশ কজন বদলির অপেক্ষায় আছেন। তাঁরাও বেতন পাননি। অভিযোগ পাওয়া গেছে, ছাড়পত্র নিতে কানিজ ফাতেমা নামের হাসপাতালের এক অফিস সহকারীকে (নার্সিং শাখা) ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকাও দিতে হয়েছে।
পিরোজপুর থেকে চমেক হাসপাতালে নতুন যোগদান করেছিলেন সিনিয়র স্টাফ নার্স পলি মজুমদার। এরই মধ্যে তাঁকে গোপালগঞ্জে শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে বদলি করা হয়েছে। গত শনিবার পলি মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত ৮ মার্চ আমার বদলির আদেশ আসে। ১৪ মার্চ ছাড়পত্র নিতে অফিস সহকারী কানিজ ফাতেমাকে ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে। তিনি অবশ্য তিন হাজার টাকা দাবি করেছিলেন। আমার জানা মতে ছাড়পত্র নিতে আসা সবার কাছ থেকেই এভাবে টাকা নেওয়া হয়েছে। ছাড়পত্র আটকে দেওয়ার ভয়ে এত দিন মুখ খুলিনি। ’
চমেক হাসপাতালে কর্মরত সিনিয়র স্টাফ নার্স ও ডিপ্লোমা নার্সিং অ্যাসোসিয়েশন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রতন নাথ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পটুয়াখালীর একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত মাসে বদলি হয়ে যাওয়া ইসরাত জাহান নামের এক সিনিয়র স্টাফ নার্সকে ছাড়পত্র নিতে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। তিনি সার্জারির ওটিতে ছিলেন। টাকা দেওয়ার বিষয়টি আমাদের ওয়ার্ডের সবাই জানেন। ’
অভিযোগ অস্বীকার করে অফিস সহকারী কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘ইতিমধ্যে ৪০ জনের বেশি নার্স (নতুন) ছাড়পত্র নিয়ে অন্যত্র যোগদান করেছেন। ছাড়পত্র দিতে তাঁদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ মিথ্যা। আমাদের সেকশনে আমরা তিনজন আছি। কে কার কথা বলছে তা জানি না। ’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/03/21/476969