২১ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:১৮

ভাবমূর্তি হারানোর আতঙ্কে পোশাক রফতানিকারকেরা

কড়া ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছেন বিজিএমইএ নেতারা

পাঁচ কোটি ডলার রফতানির লক্ষ্যমাত্র পূরণে যেখানে বার্ষিক গড়ে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন সেখানে অর্জিত হচ্ছে মাত্র ৪ শতাংশ। অবকাঠামোগতভাবে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে ১৯ শতাংশ কারখানাকে। সংস্কার কাজে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশের ১২৮টি কারখানার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে পোশাক শিল্পের আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের জোট অ্যালায়ান্স। শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কায় রয়েছে অর্ধেকেরও বেশি তৈরী পোশাক কারখানা। নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি বিবেচনায় বিদেশীদের আনাগোনায় স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব মারাত্মকভাবে বিদ্যমান। সরকার নিজেই বারবার রেড অ্যালার্ট ঘোষণা করে আতঙ্কিত করে তুলছে সংশ্লিষ্টদের। এমনই একটি প্রেক্ষাপটে আদালতের চূড়ান্ত নির্দেশে হাতিরঝিলের ক্যান্সার খ্যাত বিজিএমইএ ভবন ভেঙে ফেলতে রাজি হলেও বিশ্ববাজারে ভাবমূর্তি হারানোর মারাত্মক আতঙ্ক তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
ভবন ভাঙার বিষয়টি মেনে নিতে বাধ্য হলেও বিজিএমইএ নেতাদের চোখেমুখে এখন রাজ্যের ক্ষোভ। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সামনে পেলে সে ক্ষোভ প্রকাশ করতেও তারা পিছপা হচ্ছেন না, এতদিন যেখানে সরকারের সুরে সুর মেলাতেই অভ্যস্ত ছিলেন তারা। গত ৫ মার্চ আদালত কর্তৃক ভবন ভাঙার চূড়ান্ত নির্দেশ দেয়ার পর থেকে আয়োজিত কয়েকটি অনুষ্ঠানেই কড়া ভাষায় কথা বলেছেন বিজিএমইএ নেতারা। ভঙ্গুর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে কড়া ভাষায় কথা বলছেন তারা সরকারের সাথে। নতুন করে জমি বরাদ্দের দাবিতেও সোচ্চার হয়ে উঠেছেন বিজিএমইএ নেতারা।
সর্বশেষ গত শনিবার বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে দিনব্যাপী চাকরি মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদকে লক্ষ করে বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি হচ্ছে। তার দায়ও আমাদের নিতে হয়। আমাদের ঋণের ওপর ১২ থেকে ১৫ শতাংশ সুদ দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, যারা চুরি করছেন তাদের ধরেন, শাস্তির আওতায় আনেন। আমাদের ওপর চাপ কমান। তিনি বলেন, পরিবেশ ইস্যু মনে হয় শুধু পোশাক শিল্পেই আছে এ নিয়ে অনেক কথা আগে বলা হয়েছে, আমরা চুপ করে হজম করেছি। কিন্তু আর করব না। তিনি বলেন, কাস্টমস থেকে আমাদের নানা ধরনের হয়রানি করা হচ্ছে। পদে পদে বাধা তৈরি করা হয়। মন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, কাস্টমসের হয়রানি থেকে আমাদের মুক্তি দিন।
বিভিন্ন পর্যায়ের রফতানিকারকের সাথে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশী তৈরী পোশাকের দেশভিত্তিক সর্ববৃহৎ একক বাজার মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অগ্রাধিকারমূলক রফতানি সুবিধা (জিএসপি) হারিয়ে আহত হয়েছেন রফতানিকারকেরা আরো আগেই। অঞ্চলভিত্তিক সর্ববৃহৎ বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ইংল্যান্ডের বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণায় তারা মর্মাহত। গ্যাস-বিদ্যুতের সীমাহীন দুর্ভোগ তো এ দেশের উদ্যোক্তাদের নিত্যসঙ্গী। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ১২ জাতির জোট ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপে (টিপিপি) অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের অন্তর্ভুক্তি নতুন করে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশকে। একের পর এক বিদেশী হত্যাকাণ্ড এবং উগ্রবাদী হামলার ঘটনায় বায়ারদের ফিরে যাওয়ার প্রবণতা তো আছেই। চ্যালেঞ্জের তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে বাজার দখলে প্রতিযোগী ভারতের আগ্রাসী কর্মসূচি। পোশাক শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে নতুন করে ছয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার।
তৈরী পোশাক শিল্প খাতসংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিল ও ভারতের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আন্তর্জাতিক বাজার দখলের কৌশলে বাংলাদেশ কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের ৭০ শতাংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বিক্রি হয়। বছরে রফতানির ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশির ভাগই পোশাক খাতের। ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়া ব্রিটেনের বাজারে বাংলাদেশী পোশাক শুল্কমুক্ত সুবিধা না পেলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। ভারত সরকার পোশাক শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে ছয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ঘোষণা করেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের মধ্যে চার হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সম্ভাব্য হুমকি ও চ্যালেঞ্জগুলো যথাযথভাবে মোকাবেলা করা না গেলে ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে তৈরী পোশাক শিল্প খাত থেকে এক হাজার ৭২৭ কোটি ৭৪ লাখ মার্কিন ডলার রফতানি আয় আসবে বলে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল রফতানি আয় উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। এ সময়ে আয় হয়েছে এক হাজার ৬২১ কোটি ৯৮ লাখ মার্কিন ডলার। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি বাড়লেও এ সময়ে প্রত্যাশার চেয়ে রফতানি কম হয়েছে ১০৬ কোটি ডলার। শতকরা হারে ঘাটতির হার ৫ শতাংশের মতো। ইপিবির হিসাব অনুযায়ী, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে নিটওয়্যার পণ্য রফতানি বাবদ আয় হয়েছে ৮০৬ কোটি তিন লাখ মার্কিন ডলার। একই সময়ে ওভেন গার্মেন্ট পণ্য রফতানি বাবদ আয় হয়েছে ৮৩৫ কোটি ২৯ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে নিটওয়্যার পণ্য রফতানি বাবদ আয় হয়েছিল এক হাজার ৩৩৫ কোটি ৫৪ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার। ওই বছরের সাত মাসে আয় হয়েছিল ৭৬০ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আলোচ্য খাতে রফতানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার ৪১৬ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার।
নানা সঙ্কটে গত তিন বছরে ৬১৮ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে জানিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি মো: সিদ্দিকুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, বন্ধ হওয়ার পথে রয়েছে আরো ৩১৯ কারখানা। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিভিন্ন পর্যায়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটে বিনিয়োগ হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, বিনিয়োগের অভাবে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে না। যেখানে প্রতি বছর ২০ লাখ ব্যক্তি শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে, সেখানে গত দুই অর্থবছরে দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ছয় লাখ লোকের। তিনি বলেন, ইউরোপ- আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দা, জিএসপি ফিরিয়ে পাওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা, ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা, বাজার দখলে ভারতের ব্যাপক পরিকল্পনা, মার্কিন জোটে ভিয়েতনামের অন্তর্ভুক্তি আমাদের আরো ভাবিয়ে তুলছে। এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেয়া না হলে রফতানি বাণিজ্যে ৮৩ শতাংশ অবদান রক্ষাকারী বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প ভীষণ সমস্যায় পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/205433