২৫ জুলাই ২০২০, শনিবার, ৩:২৮

কোভিড হাসপাতালের হিসাব: মাসে ব্যয় ৫২ কোটি টাকা

চিকিৎসক নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের পেছনে ব্যয়ের হিসাবে গরমিল আছে : বিশেষজ্ঞ * পুরো হিসাব অডিটের দাবি রাখে : অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান

সারা দেশের কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্র্মীদের পেছনে মাসে ব্যয় হয়েছে ৫২ কোটি ৪৭ লাখ ৬২ হাজার ৪৮১ টাকা। চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য স্টাফদের থাকা-খাওয়া ও যাতায়াত ব্যবস্থায় এ অর্থ ব্যয় হয়েছে। দেশের সব হাসপাতাল থেকে দেয়া হিসাবের ভিত্তিতে তৈরি এক পরিসংখ্যানে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্যসেবা অধিদফতরের প্রস্তুতকৃত এই তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে এই হিসাব দেখে প্রশ্ন তুলেছেন স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, হিসাবে গরমিল আছে। অনেক হাসপাতালে প্রতি মাসে একই ধরনের ব্যয় দেখিয়েছে। এটা হতে পারে না। একাধিক হাসপাতাল আছে যারা গত দুই মাসে রোগীই নেয়নি। অথচ ব্যয় দেখিয়েছে। কাজেই পুরো হিসাবটি অডিট হওয়া প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, এই হিসাবগুলোতে কিছুটা গরমিল লক্ষণীয় তাই এটি অডিটের দাবি রাখে। আমরা চাই দেশের টাকা যেন অপচয় না হয়। এক্ষেত্রে একটি সুষ্ঠু সন্দুর অডিট করে দেখতে হবে যে, এই খাতে যে ব্যয় দেখানো হয়েছে সেটি ঠিক আছে কিনা। স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়েছে কিনা, জবাবদিহিতা রয়েছে কিনা। অডিটের মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারা দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের পেছনে ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি ২৩ লাখ ১২ হাজার ৭৪৫ টাকা। এই সময়ে দেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে ব্যয় হয়েছে ২৪ কোটি ৬৪ লাখ ১৭ হাজার ৪৯৩ টাকা।

এছাড়া বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে ব্যয় হয়েছে ১৮ কোটি ৩২ হাজার ২৪৩ টাকা। ব্যয়ের তালিকায় বলা হয়েছে, এই হিসাব মাসিক ভিত্তিতে করা। তবে প্রকৃত ব্যয় কোনোটির ক্ষেত্রে এর চেয়ে তিনগুণ এবং কোনোটির ক্ষেত্রে চারগুণ বেশি হবে। তবে তালিকায় কোনো কোনো হাসপাতাল দুই বা তিন মাসের হিসাব প্রদর্শন করেছে।

তবে এই হিসাবে অনেক গরমিল রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কোনো হাসপাতালের মাসিক ব্যয় প্রতি মাসে একই হতে পারে না। সেটা কোভিড সময় হোক বা নন-কোভিড সময়ে হোক। এছাড়া এই হিসাবের মধ্যে পুরো হাসপাতালের স্টাফদের হিসাবে দেখানো হয়েছে। অথচ সব হাসপাতালের সবাই করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন না। এছাড়া ব্যয়ের খাতগুলো স্পষ্ট করা হয়নি। তাই হিসাবের ক্ষেত্রে আরও স্বচ্ছ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় দেখানো হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ক্ষেত্রে ২০ কোটি ১২ লাখ ২৮ হাজার ৪৫৫ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে আবাসন, যাতায়াত, জ্বালানি ও অন্যান্য বিল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে মোট স্বাস্থ্যসেবা কর্মী হিসাবে ৩ হাজার ৬৮৮ জনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যার মধ্যে ১২শ’ ডাক্তার এবং ১৫৬৭ জন নার্স রয়েছেন।

মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিডে ডেডিকেটেট হাসপাতালের সব কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মাসিক ব্যয় দেখানো হয়েছে ২০ লাখ ২১ হাজার টাকা। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের বিল মে মাসে দেখানো হয়েছে ৭ লাখ ২৭ হাজার টাকা এবং জুন মাসে ১০ লাখ ২৯ হাজার ২৫৭ টাকা।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাসিক ৪০ লাখ টাকা, বরিশাল মেডিকেল কলেজে মে মাসে ব্যয় হয়েছে ১৬ লাখ ৮ হাজার ৫০০ টাকা এবং জুন মাসে ৮১ লাখ ১৪ হাজার ৬৮৩ টাকা। বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের মাসিক ব্যয় ৫০ লাখ টাকা, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এপ্রিল, মে ও জুন মাসের মোট ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩২ লাখ ১৪ হাজার ৭৫০ টাকা।

গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাসিক ব্যয় ৮২ লাখ ৫৪ হাজার টাকা, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মাসিক ব্যয় ১৫ লাখ টাকা, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যয় (মে, জুন) ৪২ লাখ ২৬ হাজার টাকা। কিশোরগঞ্জ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যয় মাসিক ৫০ লাখ টাকা।

বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোর মধ্যে অন্যতম কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। সেখানে ২৩০ জন স্বাস্থ্যকর্মীর মাসভিত্তিক খরচ দেখানো হয়েছে ৩ কোটি ৬২ লাখ ১০ হাজার টাকা। ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট মুগদা জেনারেল হাসপাতাল ১৪৩ জন স্বাস্থ্যকর্মীর মাসিক ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬ কোটি ১ লাখ ৭৪ হাজার ৯০০ টাকা। মহাখালী শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। যদিও এই প্রতিষ্ঠানে মার্চ ও এপ্রিল এবং মে মাসে কোনো কোভিড রোগী ভর্তি করা হয়নি।

এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে হাসপাতালটিতে এ পর্যন্ত ১০ থেকে ১৫ জন কোভিড রোগীর চিকিৎসা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল শাখা। রাজধানীর কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল ৪৬০ জন স্বাস্থ্যকর্মীর পেছনে ব্যয় দেখানো হয়েছে মাসিক তিন কোটি ২১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ট্রপিক্যাল ইনফেকশাস ডিজিজ (বিআইডিআইডি) ফৌজদারহাটের ১২০ জন স্বাস্থ্যকর্মীর মাসিক ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩৬ লাখ টাকা।

৩১ শয্যাবিশিষ্ট গোদাগাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রাজশাহী ৪৭ জন স্বাস্থ্যকর্মীর মাসে তিন লাখ টাকা। যারা ডরমিটরিতে অবস্থান করতেন, কোনো হোটেল ব্যবহার করেননি। ১০০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল নরসিংদী। যার ৮০ শয্যা কোভিড ডেডিকেটেড করা হয়েছিল। হাসপাতালটিতে ৪৪ জন ডাক্তার, ১৮৬ জন নার্স, ১৯১ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিযুক্ত রয়েছে। এপ্রিল, মে, জুন এই তিন মাসে এই হাসপাতালে মোট ব্যয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৫২ লাখ ২ হাজার ৩৪৩ টাকা।

এছাড়া সারা দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কোভিড চিকিৎসায় যুক্ত সরকারি হাসপাতালগুলোর ব্যয়ের হিসাব যুগান্তরের হাতে রয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে ঢাকা বিভাগের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের ৩২টি হাসপাতালের ব্যয় হয়েছে এক কোটি ৭৭ লাখ ৪২ হাজার ৩৯২ টাকা। চট্টগ্রাম বিভাগের ৪৩টি হাসপাতালের ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৫৯ লাখ ২২ হাজার ৪৫৭ টাকা। রাজশাহী বিভাগের ১৮টি হাসপাতালের পেছনে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪৫ লাখ ৬৩ হাজার টাকা।

রংপুর বিভাগের ২১টি হাসপাতালের ব্যয় দেখানো হয়েছে ৭০ লাখ ২৩ হাজার ৩৬ টাকা। খুলনা বিভাগের ২৫টি হাসপাতালের ব্যয় দেখানো হয়েছে ৭৯ লাখ ২১ হাজার ৯৮৪ টাকা। বরিশাল বিভাগের ২৬টি হাসপাতালের ব্যয় দেখানো হয়েছে ১২ কোটি ১৪ লাখ ৬ হাজার ৩৩৫ টাকা। সিলেট বিভাগের ১০টি হাসপাতালের ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪১ লাখ ১৯ হাজার ২০০ টাকা, ময়মনসিংহ বিভাগের ৫টি হাসপাতালে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২৮ লাখ ৭৪ হাজার টাকা।

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোট স্বাস্থ্যকর্মী ১৮ জন। তাদের মাসিক ব্যয় ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। অন্যদিকে সিংগাইর উপজেলায় স্বাস্থ্যকর্মী ২৬ জন, তাদের মাসিক ব্যয় ৩ লাখ টাকা। আবার ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা ৬১ জন, তাদের ব্যয় মাত্র ৩০ হাজার টাকা।

অন্যদিকে টাঙ্গাইলের ১০টি উপজেলার ৫০ শয্যাবিশিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী এবং ব্যয়ের হিসাব একই দেখানো হয়েছে। প্রতিটিতে মাসিক ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। এর পাশাপাশি ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যকর্মী দেখানো হয়েছে ১০৪ জন এবং ব্যয় দেখানো হয়েছে ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র (সহকারী পরিচালক) ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, উপজেলা পর্যায়ে ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলো মূলত আইসোলেশন সেন্টার। সেখানে রোগীদের আইসোলেশন করে রাখা হয়। তবে তাদের ব্যয় সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/329170/