১ জুলাই ২০২০, বুধবার, ১২:৩৬

দুর্দিন কাটছে না আর্থিক প্রতিষ্ঠানে, অর্থসঙ্কট প্রকট

নীতিসহায়তা দেয়ার আশ্বাস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের

ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্দিন সহসাই কাটছে না। নগদ আদায় প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে যাওয়ায় অর্থসঙ্কট দেখা দিয়েছে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের। অপর দিকে, করোনার প্রভাবে বাড়ছে আমানতকারীদের অর্থ উত্তোলনের চাপ। জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ১০ হাজার কোটি টাকার তারল্য সুবিধা চেয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। কিন্তু তাতেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনি পরিস্থিতিতে আবার ৫টি প্রধান দাবি নিয়ে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সাথে বৈঠক করে এ খাতের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশন (বিএলএফসিএ)। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তারল্য প্রবাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নীতিসহায়তা দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা জানান, আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পারায় পিপলস লিজিং অবসায়ন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান রিলায়ান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদারের প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণকেলেঙ্কারি ও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে না পারার প্রভাব পুরো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর পড়ে। এ কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আমানত প্রত্যাহারের বাড়তি চাপ ছিল আগ থেকেই। এরওপর মার্চ থেকে নতুন করে যুক্ত হয় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। একই সাথে প্রথমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জুন পর্যন্ত পরবর্তীতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের ওপর ব্যবসায়ীদের ছাড় দেয়া হয়। বলা হয়, এ সময়ের মধ্যে কেউ ঋণ পরিশোধ না করলে তাকে ঋণখেলাপি বলা যাবে না। এতে ঋণ পরিশোধ বলা চলে বন্ধ করে দেন উদ্যোক্তারা। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নগদ আদায়ের ওপর। এক দিকে নগদ আদায় কমে যাওয়া, অপর দিকে আমানত প্রত্যাহারের চাপ সবমিলে উভয় সঙ্কটে পড়ে যায় দেশের ব্যাংকবহির্ভূত ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ১০ হাজার কোটি টাকার তারল্য সুবিধা চেয়েছিল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। একই সাথে নগদ জমার হার (সিআরআর) হার কমানোর দাবি করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইতোমধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিআরআর হার এক শতাংশ কমিয়ে প্রতিদিন ১ শতাংশ এবং ২ সপ্তাহ অন্তে দেড় শতাংশ পুনর্নির্ধারণ করা হয়। গতকালের বৈঠেকে শুধু ১০ হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তার দাবি ছাড়া বাকি ৪টি দাবির বিষয়ে বিবেচনা করার আশ্বাস দেয়া হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) ভাইস চেয়ারম্যান ও আইআইডিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া গতকাল বৈঠকের বিষয়ে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আমাদের ৬টি দাবির মধ্যে ইতোমধ্যে সিআআর হার কমিয়ে দেয়া হয়েছে। আর ১০ হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সবধরনের সহয়োগিতা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। বৈঠকে বলা হয়েছে, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান অর্থসঙ্কটে পড়লে ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তারল্য সহযোগিতা পাবে। পাশাপাশি সরকারঘোষিত প্রণোদনার প্যাকেজ গ্রহণের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারল্য সহায়তা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে বৈঠকে জানানো হয়েছে।

তিনি বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণপুনর্গঠনের সময় বাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আগে এক বছরের ঋণ বকেয়া থাকলে ২৫ শতাংশ সময় অর্থাৎ তিন মাস সময় বাড়িয়ে এক বছর তিন মাস করা যেত। গতকালের বৈঠকে ৫০ শতাংশ সময় বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এক বছরের ঋণ বকেয়া থাকলে আরো ৬ মাস সময় বাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বৈঠকে, পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদি ঋণের শুধু বকেয়া সুদ পরিশোধ করে ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মোটের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তারল্য সহায়তা বাড়াতে সবধরনের নীতিসহায়তা দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

তবে এ বিষয়ে অপর একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্দিন কাটছে না সহসাই। বর্তমান পরিস্থিতিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্ব রক্ষার্থে প্রয়োজন তারল্য সহায়তা দেয়া। কিন্তু সেই তারল্য সহায়তার আশ্বাস কোথাও থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, এক দিকে করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ব্যবসাবাণিজ্য বলা চলে বন্ধ হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান তাদের আপৎকালীন ব্যয় মেটাতে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা স্থায়ী আমানত উত্তোলন করতে চাচ্ছেন। কিন্তু পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার কারণে কেউ ঋণ পরিশোধ করছেন না। এতে তারা এখন উভয় সঙ্কটে পড়ে গেছেন। পরিস্থিতি সামাল দেয়ায় জন্য তারল্য সহায়তার বিকল্প নেই। বলা হচ্ছে ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে তারল্য সহায়তা দেয়া হবে। কিন্তু চলমান পরিস্থিতিতে কোনো ব্যাংকই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্যারান্টার হতে চাইবে না। তাহলে কিভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাবে।

তিনি বলেন, হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ আদায়ের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নীতিসহায়তা দেয়া হোক, অন্যথায় তারল্য সহায়তা দেয়া হোক। এ দুয়ের কোনো বিকল্প নেই বলে ওই এমডি মনে করেন।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/512160