২৩ জুন ২০২০, মঙ্গলবার, ১:০০

তিন মাসেও টেন্ডার আহ্বান করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ

ফেরত যাচ্ছে শেবাচিমের সাড়ে ৮ কোটি টাকা

করোনা দুর্যোগের এ সময়ে যখন একের পর এক ফুটে উঠছে দেশের স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশার চিত্র, ঠিক সেই সময়ে কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ফেরত যাচ্ছে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের (শেবাচিম) অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য সরকারের বরাদ্দ দেয়া ৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।

২০১৬ সাল থেকে টানা চেষ্টা ও তদবিরের পর চলতি বছরের মার্চ মাসে বরাদ্দ আসা এই বড় অংকের অর্থ ব্যবহারে সঠিক উদ্যোগ না নেয়ায় সৃষ্টি হয়েছে এ পরিস্থিতির। বিষয়টিকে দুঃখজনক আখ্যা দিয়েছেন স্থানীয় নাগরিক সমাজের নেতারা। ৪ বছরের চেষ্টায় আসা এ টাকা ফেরত গেলে অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে এ ধরনের বরাদ্দ আর পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তারা।

২০১৬ সালে ডা. ভাস্কর সাহা যখন শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন তখন প্রথম তিনি গণপূর্ত অধিদফতরকে চিঠি দেন মেডিকেল কলেজের নতুন এবং পুরাতন কয়েকটি হলের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র তৈরির প্রাক্কলন চেয়ে। পরবর্তীতে ডা. ভাস্কর অবসরে গেলে অধ্যক্ষের দায়িত্বে আসেন ডা. মাকসুদুল হক।

দায়িত্ব নিয়ে তিনি পুনরায় আরেকটি চিঠি দিয়ে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রশ্নে জরুরিভিত্তিতে প্রাক্কলন প্রস্তুতের পুনঃতাগাদা দেন গণপূর্ত বিভাগকে। এরপর চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রাক্কলন প্রস্তুত করে অধ্যক্ষ বরাবর পাঠান গণপূর্ত অধিদফতরের ই/এম বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আইয়ুব আলী।

প্রাক্কলনে এ খাতে ব্যয় ধরা হয় ৮ কোটি ৫৩ লাখ ৮ হাজার ৫১২ টাকা। প্রাক্কলনের চিঠি পাওয়ার পর গণপূর্ত অধিদফতরকে দেয়া আরেকটি চিঠিতে প্রাক্কলন অনুযায়ী টেন্ডার আহ্বান এবং জরুরিভিত্তিতে মালামাল সরবরাহের অনুরোধ জানান ডা. মাকসুদুল হক। চিঠির জবাবে গণপূর্ত ই/এম বিভাগ জানিয়ে দেয় যে, প্রাক্কলনের বিপরীতে অর্থ বরাদ্দ না থাকায় এ কাজটি করা সম্ভব নয়।

এরপর শুরু হয় বরাদ্দ পাওয়ার চেষ্টা। বহু তদবিরের পর চলতি বছরের ৫ মার্চ স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর থেকে শেবাচিমের অনুকূলে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের বিপরীতে ৮ কোটি ৫৩ লাখ ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। টানা ৪ বছর ধরে ২ জন অধ্যক্ষের চেষ্টার ফল হিসেবে যখন সাড়ে ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ পায় শেবাচিম, তখন এর নতুন অধ্যক্ষ ডা. অসীত ভূষণ। নিয়মানুযায়ী এরপর টেন্ডার আহ্বান এবং কাজ সম্পন্ন করার কথা থাকলেও শুরু হয় কালক্ষেপণ।

সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞ একাধিক ঠিকাদার যুগান্তরকে বলেন, ‘মোট ১১ গ্রুপে এ কাজটি সম্পন্ন হতে খুব বেশি হলে এক মাসের বেশি সময় লাগার কথা না। কারণ এটি ছিল শুধুই কাঠের আসবাব প্রস্তুত ও সরবরাহের কাজ। সেই হিসাবে ১৮ মার্চ বরাদ্দের চিঠি গ্রহণ করার পর খুব সহজেই এক মাসের মধ্যে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কার্যাদেশ দিতে পারত কলেজ কর্তৃপক্ষ।

সেক্ষেত্রে ১৮ এপ্রিল কাজ শুরু হলে ১৮ মে’র মধ্যে শেষ এবং ৩০ জুনের আগেই বিল তুলে নিতে পারত ঠিকাদাররা। কিন্তু জুন মাস প্রায় পেরিয়ে গেলেও গতকাল সোমবার পর্যন্ত টেন্ডার- আহ্বান করতে পারেনি শেবাচিম কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে আবার গত ২০ জুন অবসরে গেছেন এখানকার সর্বশেষ অধ্যক্ষ ডা. অসীত ভূষণ।

বর্তমানে যে পরিস্থিতি তাতে এখন টেন্ডার আহ্বান করা হলেও একদিকে যেমন মাত্র ৮ দিনে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যাবে না, তেমনি ৩০ জুনের মধ্যে কাজ সম্পন্ন হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই। ফলে এই সাড়ে ৮ কোটি টাকা ফেরত যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প দেখছি না আমরা।’

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে শেবাচিমের বিদায়ী অধ্যক্ষ ডা. অসীত ভূষণ বলেন, ‘এ ধরনের কোনো নির্মাণ বা সরবরাহের কাজ মেডিকেল কলেজ কখনই নিজেরা করে না। সরকারিভাবে এসব বরাদ্দ আসে গণপূর্ত অধিদফতরে। তারা টেন্ডার আহ্বান করে কাজ করে। আমরা শুধু কাজ বুঝে নেই।

কিন্তু এবার রীতি ভেঙে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে শেবাচিমের অনুকূলে। ফলে বিষয়টি নিয়ে বিব্রত হয়েছি আমরা। তাছাড়া টেন্ডার আহ্বানসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ করার মতো যথেষ্ট জনবলও নেই আমাদের। ফলে আমরা স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরকে চিঠি দিয়ে বলেছি যাতে বরাদ্দ গণপূর্ত অধিদফতরকে হস্তান্তর করা হয়।’

অধ্যক্ষের এ বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে অধিদফতরের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘ওই চিঠির উত্তর আমরা দিয়ে দিয়েছি। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর থেকে বরাদ্দকৃত টাকা গণপূর্ত ই/এমকে হস্তান্তর করা সম্ভব নয়। এ টাকার বিপরীতে টেন্ডার আহ্বানসহ সকল কাজ শেবাচিমকেই করতে হবে।’

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে শেবাচিমের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘টেন্ডার আহ্বান করে খুব সহজেই কাজটি করাতে পারতেন অধ্যক্ষ। কেন তিনি সেটা করলেন না তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন।’ বরিশাল নাগরিক সমাজের সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘যতদূর জানি মেডিকেল কলেজের আবাসিক ছাত্রছাত্রীদের হোস্টেলের আসবাবপত্র তৈরির জন্য ওই সাড়ে ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল।

হোস্টেলে খাট, পড়ার টেবিলসহ অন্যান্য আসবাবপত্রের অভাবে শিক্ষার্থীরা যে কী অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয়ে আছে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। সরকার যেখানে সাড়ে ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিল সেখানে কেন যথাসময়ে টেন্ডার করে কাজটি সম্পন্ন করা হল না, তার উত্তর কর্তৃপক্ষকেই দিতে হবে। এখন যদি এ টাকা ফেরত যায় তবে তার দায়ভারও নিতে হবে শেবাচিম কর্তৃপক্ষকে। এই একটি ঘটনাই প্রমাণ করে যে, কেন ও কী কারণে আমাদের স্বাস্থ্য খাত পিছিয়ে আছে।’

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/318653/