১৯ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৮:৪৮

লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগে বিপত্তি

দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো গ্যাস বা বিদ্যুৎ নয়, বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পানি সংকটের কারণে অন্তত ২০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে আছে। জেলার শিল্প জোন হিসেবে পরিচিত সীতাকুণ্ডে ২০১৮ সালের মধ্যে কারখানাগুলোতে উৎপাদন শুরুর পরিকল্পনা থাকলেও পানি সংকটের কারণে তা হচ্ছে না। ফলে বন্ধ রয়েছে নতুন শিল্প স্থাপন। এদিকে জটিলতার আভাস পেয়ে 'ইন্দু স্টিল ইন্ডাস্ট্রি'সহ কয়েকটি কারখানা কার্যক্রম শুরুর আগেই বিনিয়োগ গুটিয়ে চলে গেছে ঢাকায়। একই কারণে শঙ্কায় আছে, কিন্তু এখনও বেকায়দায় পড়ে আছে আরও শ'খানেক প্রতিষ্ঠান। অনিশ্চয়তার মুখে রয়েছে অন্তত এক লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে জলাধার স্থাপনে চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি জরুরি চিঠি পাঠিয়েছে জেলা প্রশাসককে। এদিকে যে কোনো জলাধার ভরাট ও লিজ দেওয়া বন্ধ এবং নতুন পুকুর খনন প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। চিঠি পাওয়ার পর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সভা করে জেলা পরিষদ প্রাথমিক পর্যায়ে তিনটি জলাধার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ভূগর্ভস্থ পানি সংকট বিবেচনায় নিয়ে সারফেজ ওয়াটার সংরক্ষণের জন্য রিজার্ভার তৈরির উদ্যোগ গ্রহণের বিষয় স্বীকার করে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুস সালাম সমকালকে বলেন, 'গত জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চলে পানি সংকটের প্রেক্ষিতে সংশিল্গষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলীদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে একটি যৌথ সভা হয়। এতে আনোয়ারা, লোহাগাড়াসহ চট্টগ্রামের তিন উপজেলায় প্রথম দফায় তিনটি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে রিজার্ভার করার সিদ্ধান্ত হয়। পর্যায়ক্রমে শিল্পাঞ্চলসহ অন্যান্য উপজেলাতেও রিজার্ভার স্থাপন প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। এসব ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের পুকুর খনন সেলের কাছে অবগতি ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের সিদ্ধান্তের জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে।'

পানি সংকটের কথা স্বীকার করে জিপিএইচ গ্রুপের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল সমকালকে বলেন, 'আমাদের দৈনিক সাড়ে ৩ হাজার টন উৎপাদন ক্ষমতার নতুন কারখানার জন্য ৬০ লাখ লিটার পানি প্রয়োজন। অথচ পাচ্ছি মাত্র দেড় লাখ লিটার। ইতিমধ্যে পানির সন্ধানে বিভিন্ন গভীরতায় ৩৫টি গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। কিন্তু ভূগর্ভের ১৩০০ ফুট গভীরেও পানি মিলছে না। পাওয়া যাচ্ছে না পুকুর- কুয়ার সারফেস ওয়াটারও। এ কারণে নতুন করে শিল্প স্থাপনে কেউ এগিয়ে আসছে না। সংকট উত্তরণে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির পানি সরকারি উদ্যোগে জলাধারে সংরক্ষণের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।' পানির এমন তীব্র সংকট অব্যাহত থাকলে বিনিয়োগের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিকল্প ভাবনাও রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বজলুল হক সমকালকে বলেন, 'প্রতি বছর ২-৩ ইঞ্চি করে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছিল। হঠাৎ তা প্রতি মাসে আধা ইঞ্চি করে নামা শুরু করলে হাজার ফুটের নিচে নেমেও প্রত্যাশিত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। সীতাকুণ্ডের এসব এলাকায় শিল্পের চাকা সচল রাখতে হলে পাহাড়ের পাদদেশে জলাধার করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।' একই অভিমত স্থানীয় উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী এসএম শাহ আলমেরও।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা এলাকায় তিন মাস আগে ইস্পাত কারখানা সম্প্রসারণের কার্যক্রম শুরু করে জিপিএইচ গ্রুপ। কারখানার কাঁচামাল হিসেবে প্রয়োজন হয় প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি। এ কারণে শুরুতেই প্রতিষ্ঠানটি গভীর নলকূপ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ১৩০০ ফুট গভীরেও পানির উৎস মিলছে না। অথচ কারখানাটির উৎপাদনে যাওয়ার কথা আগামী বছর থেকে। ১০ লাখ টন বিলেট (রড তৈরির কাঁচামাল) এবং একই পরিমাণ ইস্পাত পণ্য তৈরির ক্ষমতাসম্পন্ন কারখানাটি প্রয়োজনীয় পানি জোগাড় করতে না পারলে দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়ে পড়বে।

পার্শ্ববর্তী পিএইচপি গ্গ্নাস কারখানায় বালু পরিষ্কারে প্রতিদিন লাগছে প্রায় চার হাজার টন মিঠাপানি। পানি না পেয়ে তারা পার্শ্ববর্তী জেলা ফেনী থেকে বালু পরিষ্কার করে আনছে। এলাকার অন্য কারখানাগুলোও স্থানীয় পুকুর, ডোবা, বৃষ্টির পানি, ছড়ার পানি সংরক্ষণ করে কোনো মতে উৎপাদন সচল রাখছে। উৎপাদন শুরুর অপেক্ষায় থাকা ও উৎপাদনে থাকা এসব কারখানার সবকটির মালিক হঠাৎ ভূগর্ভস্থ পানি সংকটে চোখে

শর্ষেফুল দেখছেন। কিছুদিন থেকে এ সংকট তীব্র হয়েছে। তাই নতুন করে শিল্প স্থাপনে কেউ এগিয়ে আসছেন না এ ঐতিহ্যবাহী শিল্পাঞ্চলে।

একইভাবে হঠাৎ পানির দুষ্প্রাপ্যতায় বেশি শঙ্কায় রয়েছে এলাকার ৭৬টির বেশি উৎপাদনমুখী কারখানা। একই শিল্পাঞ্চলে এর আগে প্রতিষ্ঠিত পিএইচপি ফ্লোট গ্গ্নাস কারখানাসহ (যে কারখানায় প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার টন মিঠাপানির দরকার হয়) ৫১টি শুধু ইস্পাত কারখানা। এ ছাড়া এখানে সিমেন্ট কারখানা রয়েছে-৪টি, তৈরি পোশাক কারখানা ২টি, ঢেউটিন কারখানা ৩টি, কাচ তৈরির কারখানা একটি, সুতার কারখানা ৪টি, পাটকল ৯টি ও অন্যান্য দুটি।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাহবুবুল আলম সমকালকে বলেন, 'চট্টগ্রামের বড় বড় শিল্প গ্রুপের প্রায় ১০০টি কারখানা রয়েছে এখানে। এসব কারখানায় প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। অর্ধশত ইস্পাত কারখানাসহ সবার কমবেশি পানি দরকার। ব্যক্তিগত উদ্যোগে সে সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। সরকারি উদ্যোগে সেখানে জলাধার তৈরি করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণসহ যে কোনো বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে নতুন কারখানা দূরে থাক, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বিদ্যমান কারখানাগুলোও লোকসান দিতে দিতে বন্ধ হয়ে যাবে। বিষয়টি অ্যালার্মিং বিধায় আমি জেলা প্রশাসকের জরুরি দৃষ্টি আকর্ষণ করে চিঠি দিয়েছি।'

সীতাকুন্ড শিল্পাঞ্চলে কারখানায় পানি সংকট বিষয়ে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল এন্ড ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং (ডবিল্গউ আরই) বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. রিয়াজ আকতার মলিল্গক সমকালকে বলেন, নির্বিচার ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন,পুকুর ঢোবা ভরাট ও বৃক্ষরোপণের তুলনায় ১০গুণ বেশি বৃক্ষনিধন, এই তিনটি কারণে পানির স্তর অপ্রত্যাশিতভাবে নিচে নামছে। তিনি বিকল্প পানির উৎস সন্ধানের পরামর্শ দেন সংশিস্নষ্টদের। একাজে সংগত কারণে অবশ্য সরকারও সহায়তা করবেন।

http://bangla.samakal.net/2017/03/19/278205#sthash.JE8YsjJk.dpuf