২১ জুন ২০২০, রবিবার, ৪:২৭

বড় সংকটে পোশাক শিল্প

দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে যায় শিল্প-কারখানা। লকডাউন ও ছুটির ফাঁদে পড়ে অন্যান্য সেক্টরের ন্যায় ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি দেশের বস্ত্র খাত। পুনরায় মিল-কলকারখানা চালু হলেও কোনো শিল্প ইউনিট ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। সক্ষমতার বিপরীতে অর্ডার নেই। বড় জোর ৩০ শতাংশ শ্রমিক-কর্মচারী দিয়ে মিল ফ্যাক্টরি চালানোর সুযোগ আছে। তাও কতদিন চলবে- তা অনিশ্চিত। এ হিসাবে কমপক্ষে বস্ত্র সেক্টরের ৭০ শতাংশ কর্মীর চাকরি হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ দেশের শিল্প অধ্যুষিত ৬ এলাকা আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও খুলনায় চাকরিচ্যুত হয়েছেন মোট ২১ হাজার ৩৩১ জন শ্রমিক।

যার মধ্যে ঈদের পর গত দুই সপ্তাহে ১০ হাজারের বেশি কাজ হারিয়েছেন। এছাড়া কারখানা বন্ধ হয়েছে প্রায় ৩ শতাধিকের বেশি।

শিল্প কেন্দ্রীকরণের কারণেই ৬ শিল্প এলাকায় একক খাতভিত্তিক কারখানার সংখ্যা বেশি। ৬ শিল্প এলাকায় শুধু পোশাক খাতের কারখানা আছে ২ হাজার ৮৯৩টি। এ খাতেরই ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বস্ত্র শিল্পের কারখানা আছে ৩৮৯টি। এছাড়া বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) আওতায়ও আছে বস্ত্র ও পোশাক খাতের কারখানা। এভাবে ছয় শিল্প এলাকায় মোট ৭ হাজার ৬০২টির মধ্যে পোশাক খাত কেন্দ্রিক মোট কারখানার সংখ্যা ৩ হাজার ৩৭২টি। ছাঁটাইয়ের চিত্রেও এ কেন্দীকরণের প্রতিফলন দেখা যায়।

শিল্প পুলিশ সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের ছয়টি শিল্প এলাকায় পোশাক শিল্প মালিক সংগঠন বিজিএমইএ’র সদস্য কারখানা আছে মোট ১ হাজার ৮৮২টি। এর মধ্যে ৮৬টি কারখানায় ছাঁটাই হয়েছেন ১৬ হাজার ৮৫৬ জন। ৮৬ কারখানার মোট শ্রমিক সংখ্যা ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫২ জন। পোশাক শিল্প মালিকদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএ’র সদস্য কারখানা মোট ১ হাজার ১০১টি। এসব কারখানার মোট শ্রমিক সংখ্যা ৩৩ হাজার ৮৬০ জন। যার মধ্যে মোট ১৬টি কারখানার ২ হাজার ২৯৮ জন ছাঁটাই হয়েছেন। পোশাক খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বস্ত্রশিল্প মালিক সংগঠন বিটিএমএ’র সদস্য মোট ৩৮৯টি কারখানা আছে ছয় শিল্প এলাকায়। এর মধ্যে মোট চারটি কারখানার ২৫৮ জন শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছেন। ৩৮৯ কারখানার মোট শ্রমিক সংখ্যা ২ হাজার ৭০০ জন।

বেপজার আওতায় ৬ শিল্প এলাকায় মোট কারখানা আছে ৩৬৪টি। এর মধ্যে ৮টি কারখানার মোট ৫৬ জন শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছেন। ৩৬৪টি কারখানার মোট শ্রমিক সংখ্যা ১০ হাজার ৪৯ জন। ৬ শিল্প এলাকায় বস্ত্র ও পোশাক খাতের দুই সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বেপজার আওতাভুক্তগুলোর বাইরে চামড়াজাত পণ্য, আসবাব, সেলফোন সংযোজন, ওষুধ সব খাত মিলিয়ে অন্যান্য কারখানা আছে ৩ হাজার ৮৬৬টি। এসব কারখানার মোট শ্রমিক সংখ্যা ১০ হাজার ৬৪৫। অন্যান্য খাতের ১৫টি কারখানার ১ হাজার ৮৬৬ জন শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প মালিকরা জানান, বিজিএমইএ’র নেতারা যাই বলুক না কেন, বাস্তবতা হল বর্তমানে গার্মেন্টে যে কাজ আছে সেখানে ৩০ শতাংশের বেশি শ্রমিক কাজে লাগানোর সুযোগ নেই। যদি সুবিধামতো অর্ডার না পাওয়া যায় তাহলে চালু রাখা তো দূরের কথা, পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেয়া ছাড়া কোনো পথ খোলা থাকবে না। এর সঙ্গে ছাঁটাইয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। কাজ না থাকলে বেতন দেবে কে?

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাকেঞ্জির তথ্য অনুযায়ী করোনার প্রভাবে আগের বছরের তুলনায় চলতি বছর বিশ্বের পোশাক বাজারে বিক্রি ৩০ শতাংশ হ্রাস পাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি ১০ বিলিয়ন ডলার হ্রাস পাবে। চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) পোশাক শিল্পে ঋণাত্মক ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। করোনার প্রভাবে মার্চ পর্যন্ত ৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্রয়াদেশ বাতিল হয়ে গেছে।

৪ঠা জুন এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক এমন বাস্তবতা তুলে ধরে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কারখানাগুলো ক্যাপাসিটির ৫৫ শতাংশ কাজে লাগাতে পারছে। এ ক্যাপাসিটিতে কারখানা চালিয়ে শতভাগ কর্মী রাখা উদ্যোক্তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এমন প্রেক্ষাপটে জুন থেকে শ্রমিক ছঁাঁটাই করা হতে পারে। এটি অনাকাঙ্খিত বাস্তবতা, কিন্তু করার কিছু নেই।

বিকেএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ভোগ ও চাহিদা কমে যাওয়ায় সারা বিশ্বেই শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। বাংলাদেশেও এর বাইরে নয়। কারণ একদিকে পোশাকের অর্ডার কমে গেছে। তিনি বলেন, কোনো মালিকই শ্রমিক ছাঁটাই করতে চান না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মহামারির কাছে মালিকরা অসহায়। শুধু গত ২ মাসেই প্রায় ৩০০ গার্মেন্ট বন্ধ হয়েছে। এছাড়া তৈরি পোশাকের পশ্চাৎপদ শিল্পে করোনার আঘাত লেগেছে। টেক্সটাইল, এক্সেসরিজ, পরিবহন, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স খাতে চাহিদা কমেছে। এসব খাতে কর্মরত শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়ছেন।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=232166