১৯ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৮:৪৭

ডায়রিয়া বাড়ার আশঙ্কা

প্রতিদিনই বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটছে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা। সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে ঢাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। গরম আর বৃষ্টির মাঝে বেড়ে যায় ডায়রিয়ার প্রকোপ। এ ক্ষেত্রে ভয় কেবলই খাবার পানি নিয়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দূষিত পানির কারণেই দেখা দেয় ডায়রিয়া-কলেরার মতো রোগ। জন্ডিস নামে পরিচিত ভাইরাল হেপাটাইটিসের মূলেও দূষিত পানি। পানিবাহিত এসব রোগ সৃষ্টির পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে রোটা ভাইরাস। নানামুখী চেষ্টা চালিয়েও রোটা ভাইরাস ঠেকানো যাচ্ছে না। এখনো দেশে বছরে প্রায় ২৪ লাখ শিশু রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, যাদের অনেকের মৃত্যুও ঘটে সময় মতো চিকিৎসা নিতে না পারায়।


আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. আজাহারুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, কয়েক দিন আগেও ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি ছিল। গত সপ্তাহে কিছুটা কমলেও সপ্তাহখানেক পর আবার ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিতে পারে। এ জন্য এখনই সবার সতর্ক থাকা জরুরি। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই নিরাপদ খাবার পানি ব্যবহার নিশ্চিত করার ওপর জোর দিতে হবে। কারণ প্রধানত পানির মাধ্যমেই এ ধরনের রোগের জীবাণু ছড়ায়। রোটা ভাইরাস এ ক্ষেত্রে বড় একটি সমস্যা হয়ে আছে।


আইসিডিডিআরবি হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ডায়রিয়া নিয়ে প্রতিদিন যেসব শিশু হাসপাতালে আসে তাদের মধ্যে বেশির ভাগই থাকে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত।


স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারিতে দেশের সাতটি বিশেষায়িত হাসপাতালে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে এক সার্ভেইলেন্সের (নিবিড় পর্যবেক্ষণ) মাধ্যমে দেখা গিয়েছিল ৮২ শতাংশই রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত। ওই সব শিশুর মধ্যে আবার ৬-১১ মাস বয়সী শিশুদের এ ভাইরাসে আক্রান্তের হার ছিল ৮৫ শতাংশ। এ নিয়ে দেশে রোগ বিজ্ঞানীদের মধ্যে নতুন করে দেখা দিয়েছে উত্কণ্ঠা।


বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে শিশুদের ডায়রিয়ার জন্য দায়ী প্রধান চারটি ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে রোটা ভাইরাস। এটি প্রধানত পানির মাধ্যমে সহজে ছড়াতে পারে।


ঢাকার বাইরে গত এক মাসে জয়পুরহাটে ব্যাপক হারে দেখা দেয় রোটা ভাইরাসের সংক্রমণ। এতে বহু শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়, যাদের মধ্য থেকে গুরুতর অবস্থায় পাঁচ শতাধিক শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হয় জয়পুরহাট সদর হাসপাতালে।


জয়পুরহাটের সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান জানান, জেলার বিভিন্ন এলাকায় রোটা ভাইরাস থেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়া রোগীদের নিয়ে আসা হয় সদর হাসপাতালে। মূলত অনিরাপদ পানির মাধ্যমেই রোটা ভাইরাস এসব রোগীর শরীরে প্রবেশ করেছে। এ অবস্থা থেকে রেহাই পেতে হলে খাবার পানি নিরাপদ করার ব্যবস্থা রাখতে হবে।


রোটা ভাইরাস নিয়ে উত্কণ্ঠা প্রকাশ করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহামুদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ডায়রিয়ার ভয় আগের তুলনায় কমলেও বিপজ্জনক রোটা ভাইরাসের প্রকোপ কমেনি, বরং আগের তুলনায় আরো বেশি ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। ফলে এখনো ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু একেবারে বন্ধ করা যাচ্ছে না। সংখ্যায় কম হলেও মৃত্যু এখনো ঘটছেই। তাই এর উৎস দূষিত পানির ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। নিরাপদ পানি পান করার ব্যাপারে ঘরে ঘরে সচেতনতা বাড়াতে হবে।


ড. মাহামুদুর রহমান বলেন, দেশে এখন বেসরকারিভাবে রোটা ভাইরাস প্রতিরোধী ভ্যাকসিন পাওয়া যায়, কিন্তু এর দাম অনেক বেশি। এই ভ্যাকসিন কিনে প্রয়োগ করার মতো সক্ষমতা সবার হয় না। আর সরকারিভাবেও দেশে রোটা ভাইরাসের ভ্যাকসিন দেওয়া এখনো শুরু হয়নি। ২০১৮ সাল থেকে সরকারিভাবে এ ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু করার জন্য প্রক্রিয়া চলছে।


আইইডিসিআরবি সূত্রে জানা যায়, প্রতি মাসে দেশের সাতটি হাসপাতালে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করে চিকিৎসা দেওয়া হয় বিশেষ সার্ভেইলেন্স কার্যক্রমের আওতায়। এসব হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিনই বিভিন্ন হারে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। গত বছরের জানুয়ারি মাসে পরিচালিত সার্ভেইলেন্স অনুসারে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ৬৮৭ শিশুর শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে দেখা যায় ৮১ শতাংশই রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত। কোনো কোনো হাসপাতালে এই হার শতভাগেও পৌঁছেছে।


অধ্যাপক মাহামুদুর রহমান জানান, এই ভাইরাস রোধে ভ্যাকসিন ছাড়া এখনো আর কোনো বিকল্প চিকিৎসা চালু হয়নি। কেবল কিছু পারিপার্শ্বিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোগীকে কিছুটা সুস্থ রাখা যায়। এ ছাড়া রোটা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রধানত শীত মৌসুমে বেশি থাকলেও এটা বছরের অন্যান্য সময়ে ৫৭ শতাংশের নিচে থাকে না। ফলে সব সময়ই এ ক্ষেত্রে সতর্কতা প্রয়োজন।
আইসিডিডিআরবির এক সার্ভেইলেন্সে দেখা গেছে, দেশে ডায়রিয়ার জন্য দায়ী ভি-কলেরি, সিগেলা, ইটিইসি ও রোটা ভাইরাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় সংক্রমণ রয়েছে রোটা ভাইরাসের।


বিশেষজ্ঞরা জানান, রোটা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মানুষের শরীরে এর প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। উপসর্গ হিসেবে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রথমে শুরু হয় বমি। এরপর আস্তে আস্তে পানির মতো পাতলা পায়খানা হতে থাকে। খুব কম সময়ের মধ্যে ডায়রিয়া তীব্র আকার ধারণ করে এবং পানিশূন্যতা এত বেশি হয় যে সময় মতো চিকিৎসা দেওয়া না গেলে জীবননাশের আশঙ্কাও দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া সঙ্গে জ্বর ও পেট ব্যথাও থাকতে পারে। ৯ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে বমি ও জ্বর। ডায়রিয়া থাকতে পারে ২১ দিন।


বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকার বা স্থানীয় সরকারের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সবার জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতার মাধ্যমে সব পরিবারেরই উচিত পানি নিরাপদ করার বিভিন্ন প্রযুক্তি বা উপকরণ ব্যবহার করা। ভালো মানের ফিল্টার ব্যবহারও এ ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/03/19/476134