১৪ জুন ২০২০, রবিবার, ৪:০৯

অসঙ্গতিপূর্ণ তালিকায় টেকনোলজিস্ট নিয়োগ

দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিশ্চিতে বিশেষ বিবেচনায় ১৮৩ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অযোগ্যদের নিয়োগ দিতে নানা ছলচাতুরী করে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে। আজ অধিদফতরে এ নিয়োগের বিষয়ে প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হবে বলেও জানা গেছে। যদিও পুরো প্রক্রিয়াটি অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।

তারা বলেন, দেশের করোনা প্রতিরোধে যদি টেকনোলজিস্টদের বিশেষ প্রমার্জনায় নিয়োগ দিতে হয় তবে যারা প্রথম থেকে কাজ করেছেন তাদের নিয়োগ পাওয়ার কথা। কিন্তু করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার প্রথম হাসপাতাল বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে যারা কাজ করছেন তাদের নাম নেই তালিকায়। নেই মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাম। যেসব হাসপাতালে সরকারি পর্যায়ে কর্মরত মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের অভাবে অনেকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন তাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়নি। অথচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের তালিকা প্রণয়ন করে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।

এসব অনিয়ম নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনী ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে।

অধিদফতরের পরিচালক প্রশাসন স্বাক্ষরিত ১৮৩ জনের তালিকা যুগান্তরের হাতে এসেছে। সেখানে দেখা গেছে তালিকায় ১৮৩ জনের মধ্যে ২৩ জনের নাম এসেছে অধিদফতরের পরিচালকের (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) দফতর থেকে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থ্য ব্র?্যাক থেকে ৩৪, এনটিপি (জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি) থেকে ৬০, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৫, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ থেকে ৪, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে ২, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১, রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে ১, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়া থেকে ১ জন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪, এম আবদুর রহমান মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর থেকে ১১, ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জ থেকে ২, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ থেকে ৯, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ থেকে ২, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে ১, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল থেকে ৪, শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল থেকে ১ জন, সিভিল সার্জন অফিস, নরসিংদী থেকে ৫ জন, কুর্মিটোলা ৫০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল থেকে ৬, আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ, নোয়াখালী থেকে ২ জন। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান থেকে আইদেশী (Institute for developing Science & Health Initiatives) থেকে ৪ জন এবং জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট থেকে ১ জন। সব মিলিয়ে ১৮৩ জন।

জানতে চাইলে পরিচালক এনটিপি ও লাইন ডিরেক্টর এমবিডিসি অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম বলেন, তার প্রতিষ্ঠানে ২ মাসের জন্য ৬০ জন টেকনোলজিস্ট নেয়া হয়েছে ইউএনএফপিএর অর্থয়নে। তবে বিশেষ বিবেচনায় নিয়োগের জন্য তার কাছে কোনো তালিকা চাওয়া হয়নি।

একই ধরনের মন্তব্য করেন পরিচালক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অধ্যাপক ডা. ইকবাল কবীর। তিনি বলেন, আইইডিসিআরের কিছু টেকনোলজিস্ট দরকার হয়, যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করবেন। কিন্তু তাদের বেতনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তার বিভাগ থেকে বেতনের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু তাদের প্রমার্জনায় নিয়োগের বিষয়ে তার জানা নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গত ৪-৫ বছর ধরে দৈনিক ভিত্তিতে/মাস্টাররোলে প্যাথলজি বিভাগে কর্মরত আছেন চারজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এবং দেড় থেকে দুই বছর ধরে কর্মরত আছেন ২ জন। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ৬ জন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়মিত করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের চাহিদা মোতাবেক নাম প্রেরণ করেন। কিন্তু ১৮৩ জনের মধ্যে তাদের ঠাঁই হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ১৮৩ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্টের তালিকা দৃশ্যমান অসঙ্গতিপূর্ণ। যেমন- ১. পরিচালক (প্রশাসন) কার/কোন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ১৮৩ জনের নামের তালিকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন, তার প্রেরিত চিঠিতে সে কর্তৃপক্ষ/কোন নির্দেশনার স্মারক উল্লেখ নেই। ২. প্রেরিত তালিকাটিতে মহাপরিচালকের অনুমোদনের বিষয়টি উল্লেখ নেই। সাধারণত এ ধরনের চিঠিতে মহাপরিচালকের অনুমোদন রয়েছে বলে উল্লেখ করা থাকে। ৩. প্রেরিত চিঠিতে উক্ত ১৮৩ জনকে সরাসরি স্থায়ী নিয়োগের কোনো প্রস্তাব/সুপারিশ নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কার প্রস্তাবে/সুপারিশে তাদেরকে সরাসরি স্থায়ী নিয়োগ দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা চেয়ে সারসংক্ষেপ পাঠালেন সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। ৪. প্রেরিত চিঠিতে যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ রয়েছে তার মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান/এনজিওর নাম রয়েছে। সেসব প্রতিষ্ঠানে কর্মচারী নিয়োগ হয় তাদের নিজস্ব নিয়মে। সেখানে স্বাস্থ্য বিভাগ কিভাবে সরকারি কর্মচারী নিয়োগ করে সে বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। যেমন বিএসএমএমইউ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এনজিও ব্র্যাক। এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারিভাবে কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে পদায়নের ক্ষমতা স্বাস্থ্য বিভাগের নেই। ওই সব প্রতিষ্ঠানে কে কাজ করবে, কিভাবে করবে সেটা তাদের নিজস্ব বিষয়। এখানে স্বাস্থ্য বিভাগের কিছু করণীয় নেই। ৫. দেশের হাসপাতাল/চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালকের (হাসপাতাল) (মেডিকেল এডুকেশন) সরাসরি তত্ত্বাবধানে, সেখানে কি করে পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এবং এনটিপি থেকে টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেয়া হয় বা নিয়োগদানের জন্য তালিকা তৈরি হয়? পরিচালক (প্রশাসন) নিয়োগ কমিটির সভাপতি তার স্বাক্ষরে নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়। ৬. স্বাস্থ্য বিভাগ কোভিড আক্রান্তদের সেবা করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক/অস্থায়ী/মাস্টার রোলে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ করা হবে বা কাজ করার জন্য কোন আহ্বান/ঘোষণা দেয়নি।

সামগ্রিক বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, টেকনোলজিস্ট নিয়োগে অনিয়মের বিষয়ে তিনি কোনো অভিযোগ পাননি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই সরকারি নিয়ম অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তবে বেকার অ্যান্ড প্রাইভেট সার্ভিসেস মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান বলেন, এ অনিয়মের বিষয়ে যাবতীয় অভিযোগ মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছে। যার কপি তার কাছে সংরক্ষিত আছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/315602/