১৯ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৮:৩৯

উদ্বেগ জানিয়ে বাংলাদেশকে ভারত ও শ্রীলংকা সরকারের চিঠি

সাফটার কার্যকারিতা স্থগিত

দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বা সাফটার কার্যকারিতা সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে পড়েছে। দুই মাস ১৬ দিন আগে এই চুক্তির আর্টিকেল-৭ এর ট্রেড লিবারালাইজেশন প্রোগ্রামের (টিএলপি) কার্যকারিতার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে, যা এখনও নবায়ন করা হয়নি। মেয়াদ শেষ হওয়ায় সাফটার আওতায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বিশেষত বাংলাদেশের হ্রাসকৃত শুল্কহারে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এর ফলে সার্কভুক্ত আঞ্চলিক দেশগুলোর বাণিজ্যে ব্যাঘাত ঘটছে। সাফটার আওতায় বাংলাদেশের আমদানি কিংবা রফতানিতে ৪ হাজার ৬০০ পণ্যের হ্রাসকৃত শুল্ক হারের লেনদেন সুবিধা জড়িত। কিন্তু এখন চুক্তির কার্যকারিতা না থাকায় শুল্ক সুবিধার এসব পণ্যের শুল্ক হারের কোনো মানদণ্ড নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। এতে বাংলাদেশী রফতানিকারকসহ সার্কভুক্ত দেশে বাণিজ্য পরিচালনাকারী সব রফতানিকারকই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে ভারত ও শ্রীলংকা। এ পরিস্থিতিতে নিজেদের উদ্বেগ জানিয়ে শুল্কায়ন জটিলতার আশু সুরাহা চেয়ে শ্রীলংকা ও ভারত সরকার বাংলাদেশকে চিঠি পাঠিয়েছে।


তবে এ নিয়ে এখনও সমাধানের পথ তৈরি করতে পারেনি বাংলাদেশ। কারণ সাফটা চুক্তি কার্যকারিতা পুনর্বহাল করতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের এর আগে জারি হওয়া প্রজ্ঞাপনটির সংশোধন করতে হবে। এটি করতে হলে সাফটা চুক্তির আর্টিকেল-৭ এর টিএলপি কার্যকরের ক্ষেত্রে শুল্কায়নের হারও পুনর্বিবেচনা করতে হবে। অন্যদিকে এই চুক্তির আওতায় প্রত্যেক সদস্য দেশেরই একটি করে স্পর্শকাতর পণ্য তালিকা রয়েছে। সাফটার বিধিবদ্ধ নিয়ম হল- এ তালিকার পণ্য সংশ্লিœষ্ট দেশে রফতানি করা যাবে না। এ ধরনের স্পর্শকাতর পণ্যের তালিকায় বাংলাদেশের রয়েছে ১ হাজার ২৫৪টি পণ্য। একইভাবে ভারতের ৮৬৫টি, শ্রীলংকার তালিকায় ১ হাজার ৭৯টি, পাকিস্তানের ১ হাজার ১৯১টি, আফগানিস্তানের ১ হাজার ৭২টি, মালদ্বীপের ৬৭১টি, ভুটানের ১৫৭টি পণ্য। এছাড়া স্পর্শকাতর তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ ও নেপালের তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল পণ্য। সাফটার নিয়ম অনুযায়ী এসব স্পর্শকাতর পণ্যের তালিকা কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু এ বিষয়ে ভারত সাফটা চুক্তির পুনর্বহাল চাইলেও স্পর্শকাতর পণ্যের তালিকা ছোট করার বিষয়ে নিশ্চুপ। ফলে এসব পণ্যের শুল্ক হার কোন স্তরে নির্ধারণ করা হবে তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা কাজ করছে। তাছাড়া এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর, ট্যারিফ কমিশন ও এফবিসিসিআইর যৌথ সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে। এসব কারণে সাফটা চুক্তির নবায়ন প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতায় আটকে আছে।


জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এফটিএ শাখার অতিরিক্ত সচিব মো. শফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এ জটিলতা রোধকল্পে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এফটিএ বিভাগ থেকে ইতিমধ্যেই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জারিকৃত প্রজ্ঞাপন নং-৭৮-আইন/২০১৫/০৬/শুল্ক প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার অনুরোধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্যমান শূন্য থেকে ৫ শতাংশ শুল্ক হার অব্যাহত রাখার ব্যবস্থার জন্য সুপারিশ করা হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অভিন্ন একটি বাজার গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই ২০০৬ সালে সাফটা চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। যদিও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। এ চুক্তি কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কারণ বিশ্বে যতগুলো আঞ্চলিক বাণিজ্য জোট রয়েছে, এর মধ্যে সার্ক অঞ্চলে আন্তঃবাণিজ্য সবচেয়ে কম। গত তিন দশকে সার্কের বাণিজ্য অবদান মাত্র ৭ শতাংশ।


এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সাফটা চুক্তির শুল্ক উদারীকরণের শর্ত অনুযায়ী শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি উন্নত দেশের জন্য ২০১৩ সাল এবং স্বল্পোন্নত দেশের জন্য ২০১৬ সাল পর্যন্ত নির্ধারিত। নির্ধারিত সময় শেষে তা পর্যালোচনা করে পুনরায় নবায়ন হওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে প্রতিবারই স্পর্শকাতর পণ্যের তালিকা কমিয়ে আনতে হয়। নন-ট্যারিফ বেরিয়ারের বিষয়ে সমাধান খুঁজতে হয়। তাই চুক্তিটি নবায়নের সময় এ ধরনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। তবে কোনো কারণেই এ অজুহাতে আঞ্চলিক এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া উচিত নয়। অধিকতর পর্যালোচনা ও ভেটিং পর্ব শেষ করে তা দ্রুত প্রজ্ঞাপন আকারে জারির মাধ্যমে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান হতে পারে।


রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী যুগান্তরকে বলেন, সাফটায় বড় অন্তরায় হচ্ছে আঞ্চলিক বাণিজ্যের দীর্ঘ স্পর্শকাতর পণ্য তালিকা। সাফটায় ভারত হল সবচেয়ে বড় দেশ। তার সঙ্গে বাংলাদেশ ছাড়া অধিকাংশ দেশের মধ্যে রয়েছে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি। সাফটা চুক্তির আওতায় প্রত্যেক সদস্য দেশেরই একটি করে স্পর্শকাতর পণ্য তালিকা রয়েছে। এ তালিকার পণ্য সংশ্লিষ্ট দেশে রফতানি করা যাবে না এটা হল বিধিবদ্ধ নিয়ম। ফলে সাফটা থেকে বাংলাদেশের পাওয়ার অনেক কিছু থাকলেও স্পর্শকাতর পণ্যের তালিকা ছোট না হওয়ায় এর থেকে আশানুরূপ বাণিজ্য সুবিধা মিলছে না। তবে তিনি মনে করেন, এরপরও আঞ্চলিক বাণিজ্য জোটে সাফটাই সবচেয়ে সক্রিয়। সৃষ্ট জটিলতা দ্রুত নিরসন হওয়ার যেমন দরকার রয়েছে, তেমনি দ্বিপক্ষীয় নোগোসিয়েশনের মাধ্যমে স্পর্শকাতর পণ্যের তালিকাও ছোট করে আনার পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ রাখেন তিনি।


জানা গেছে, সাফটা চুক্তির আর্টিকেল-৭ এর ট্রেড লিবারাইজেশন প্রোগ্রাম (টিএলপি) কার্যকর করার জন্য অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে সাফটা স্পর্শকাতর পণ্যের তালিকা ছাড়া বাংলাদেশ কাস্টমস ট্যারিফের ৪ হাজার ৬০৯টি পণ্য হ্রাসকৃত শুল্ক হারে (০-৫%) সাফটা সদস্য দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে আমদানি করা যেত। একই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের পণ্যও সাফটাভুক্ত দেশগুলোয় এই শুল্ক হারে রফতানি করা যেত। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে বাণিজ্য উদারীকরণ একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই লক্ষ্যে সাফটা টিএলপি-এর আওতায় দুই বছর মেয়াদি ফেইজ-১ এবং আট বছর মেয়াদি ফেইজ-২ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সব সদস্য দেশ ক্রমান্বয়ে শুল্ক হার শূন্য থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে এনেছে। হ্রাসকৃত শুল্ক হারের এই ধারা আগামীতেও অব্যাহত রাখার কথা। এ বিষয়ে সবাই প্রতিশ্রুতিবদ্ধও। এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চুক্তি শাখার দায়িত্বশীল সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে জানিয়েছে, এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি একটি বৈঠক করেছে। ওই বৈঠক থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়। তারা হ্রাসকৃত শুল্ক হার আগের স্তরে অর্থাৎ শূন্য থেকে ৫ শতাংশ অব্যাহত রাখার সুপারিশ দিয়েছে। এই মতামত পাওয়ার পর আমরা অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জারিকৃত আগের প্রজ্ঞাপনটি প্রয়োজনীয় সংশোধনের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ে পাঠিয়েছে। শিগগিরই তা জারি করা হবে। যার মধ্য দিয়ে সাফটার কার্যকারিতা আগের মতোই পুনর্বহাল হবে।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/03/19/110189/