১১ জুন ২০২০, বৃহস্পতিবার, ২:৩৪

সিলিন্ডার নাকি মৃত্যুফাঁদ

অনলাইনে অক্সিজেন কেনার হিড়িক অতিরিক্ত অক্সিজেনে ফুসফুসের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার শঙ্কা

দেশে প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যের সংখ্যা বাড়ছে; অথচ চিকিৎসা মিলছে না। হাসপাতালে আইসিইউ বেড ও অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য রোগীদের হাহাকার; কিন্তু মিলছে না সেবা। এমনিক করোনার কারণে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও চিকিৎসা মিলছে না। স্বাস্থ্যসেবার এই বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনার হিড়িক পড়ে গেছে। সচিবালয়ের বিপরীতে তোপখানা রোডের বিএমএ ভবনে সিলিন্ডারের গ্রাহকদের প্রচন্ড ভিড়। এ সুযোগে অসৎ ব্যবসায়ীরা সিলিন্ডারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুণ। জানতে চাইলে প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. আবদুল্লাহ জাকারিয়া বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঘরে অক্সিজেন নেয়া উচিত নয়। রোগী বাইরে থেকে বাড়তি অক্সিজেন নিলে তাদের ফুসফুসের অক্সিজেন ধারণক্ষমতা ব্যাহত হতে পারে। ফুসফুসের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বেশি অক্সিজেন শরীরে অক্সিজেনের বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। দ্বিতীয় কারণ, সিলিন্ডারের বিশুদ্ধ অক্সিজেন অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ। অক্সিজেন সিলিন্ডারের আগুনের স্ফুলিঙ্গ এসে পড়তে পারে, সেটা গুরুতর অগ্নিকান্ড ঘটাতে পারে।

করোনাভাইরাস সংক্রান্ত নিয়মিত অনলাইন স্বাস্থ্য বুলেটিনে গতকালও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেছেন, কেউ সিলিন্ডার কিনে বাসায় ব্যবহার করবেন না। এটা রোগীর জীবনের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, শ্বাসকষ্ট হলেই অক্সিজেন নেয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ পালপিটিশনসহ অনেক কারণেই শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। দেহে কতটুকু অক্সিজেন দরকার তার জন্য রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। সাধারণ অক্সিজেন দেয়া হয় মাস্কের সাহায্যে ও ভেন্টিলেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে। দুটি পদ্ধতিতেই চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন। কমবেশি হলে শিশুদের রেটিনায় চাপ পড়ে চিরতরে অন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং প্রাপ্তবয়স্ক ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের সেল ড্যামেজ হতে পারে।

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ইয়াসমিন হেমায়েত উদ্দিন বলেন, বেসরকারি খাতের উপর অতি নির্ভরশীলতার কারণেই এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। আসলে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে উন্নত করার ব্যাপারে কোন দূরদর্শিতা নেই। ফলে মানুষ অসুস্থ হলে চিকিৎসা পাবে না ভেবেই নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি বুঝেই সিলিন্ডার কিনছে।

জানা যায়, করোনা প্রাদুর্ভাবের পর স্বাস্থ্যসেবার বেহাল চিত্র ফুটে ওঠায় অনলাইনে অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনার রীতিমতো হিড়িক পড়ে যায়। বাড়িতে চিকিৎসাধীন করোনা রোগীরা ব্যাপকভাবে অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন। অনলাইনে প্রচুর চাহিদার কারণে হোম সার্ভিসে অক্সিজেন ডেলিভারির বেশকিছু প্রতিষ্ঠানও রাতারাতি গজিয়ে উঠেছে। আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি হচ্ছে সিলিন্ডার। কেউ কেউ রোগী বাঁচাতে ভাড়ায় নিচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডার। এছাড়াও পোর্টেবল অক্সিজেন ক্যান, পোর্টেবল ভেন্টিলেটর ও দেহের অক্সিজেন লেভেল পরিমাপের জন্য পালস অক্সিমিটার নামের ছোট একটি যন্ত্র অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীতে সক্রিয় অক্সিজেন সিলিন্ডার হোম ডেলিভারি দেন এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, মূলত এপ্রিল মাস থেকে তাদের কাছে সিলিন্ডারের বাড়তি চাহিদা আসতে থাকে। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে চাহিদা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা মেটানোই যাচ্ছে না। স্টক ফুরিয়ে যাওয়ায় অনেকে হোম ডেলিভারি সেবা বন্ধ রেখেছেন। সুযোগ বুঝে কেউ কেউ একেকটি সিলিন্ডার বিক্রি করছেন বাজার মূল্যের চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি দামে।

চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোগীর জন্য বিক্রি করা অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো কোথা থেকে আসছে এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ কিনা তা যাচাই ছাড়াই বাজারজাত করা দন্ডনীয় অপরাধ। চাহিদার কারণে খোলাবাজারে এভাবে ঢালাও অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি করা কোনোভাবেই উচিত নয়। তাছাড়া বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখার ফলে অগ্নিকান্ডের বড় ধরনের ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে।

সূত্র জানায়, করোনা হাসপাতালগুলোতে রীতিমতো কাড়াকাড়ি করে অক্সিজেন ব্যবহার করতে হচ্ছে রোগীদের। গুরুতর অসুস্থ রোগীরা বিছানা ছেড়ে উঠতে না পারলে নির্মম পরিণতির শিকার হচ্ছেন। হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা এতটাই খারাপ যে, একটি মাত্র সিলিন্ডার ওয়ার্ডের কোনো এক জায়গায় রাখা থাকে। শ্বাসকষ্টে থাকা রোগীদের পালা করে সেখানে গিয়ে অক্সিজেন মাস্ক পরতে হয়। ভিড় লেগে যাওয়ায় একজন বেশিক্ষণ নিতে পারেন না। এ অবস্থায় জীবন বাঁচানোর তাগিদে কেউ কেউ আগেই অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে রাখছেন বাসায়। কারণ সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে গিয়েও লাভ হচ্ছে না।

অনলাইনভিত্তিক অক্সিজেন সিলিন্ডার হোম সার্ভিসের এক প্রতিষ্ঠান ‘পি-৪ হেলথ’ বিক্রির জন্য ওয়েবসাইটে নানা ব্র্যান্ডের অক্সিজেন সিলিন্ডারের ছবিসহ মূল্য তালিকা দিয়েছে। দেখা যায়, ১৫শ’ লিটার সিলিন্ডারের দাম ১৩ হাজার ৮শ’ টাকা এবং ২ হাজার লিটারের দাম ১৬ হাজার ৭শ’ টাকা। এর সঙ্গে অক্সিজেন মাস্কের দাম ও হোম ডেলিভারি চার্জ নেয়া হচ্ছে আরও প্রায় ৬শ’ টাকা।

জানতে চাইলে পি-৪ ফেসবুক পেইজের স্বত্বাধিকারী মেসবাহ উদ্দিন বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ যত বাড়ছে সিলিন্ডারের চাহিদাও তত বাড়ছে। বাজারে সিলিন্ডারের সঙ্কট। এ কারণে আমাদের ডেলিভারি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন প্রতিদিন সিলিন্ডার চেয়ে এত বেশি ফোন আসছে যে, বাধ্য হয়েই হোম ডেলিভারির জন্য নির্ধারিত ফোনটি বন্ধ রাখতে হয়। তিনি জানান, সিলিন্ডারে বাজার মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। তাছাড়া অক্সিজেন ব্যবহারের সময় পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত ফলো মিটারও পাওয়া যাচ্ছে না। দেড় হাজার টাকার ফলো মিটার এখন বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রির জন্য শপ বিডি ডটকম, হোম সার্ভিস, ইসরাত অক্সিজেন হোম সার্ভিস, অক্সিজেন সাপ্লাই ও সালাউদ্দিন অক্সিজেন সাপ্লাইসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে অর্ডার নিচ্ছে। অক্সিজেন সিলিন্ডারের পাশাপাশি অনলাইনে মাস্ক, গøাভস ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ করোনাভাইরাস সুরক্ষা পণ্য বিক্রি করছে। হোম ডেলিভারির জন্য রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে দোকান ভাড়া নিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখার অস্থায়ী গোডাউনও তৈরি হয়েছে। নদ্দা ও বাড্ডা এলাকায় এ ধরনের গোডাউনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। নদ্দা এলাকা থেকে লিনডে বাংলাদেশ ও ইসলাম অক্সিজেনের সিলিন্ডার সরবরাহ করছেন জিয়া নামের একজন ব্যক্তি। অনলাইনে মোবাইল নম্বর ও সিলিন্ডারের মূল্যসহ মাত্র ২ ঘণ্টার মধ্যে হোম ডেলিভারি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে তার ফেসবুক পেইজে।

গতকাল বুধবার যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির আগে প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ৫-৬টি সিলিন্ডার হোম ডেলিভারি হতো। এখন চাহিদা অনেক। পাইকারি মার্কেটেও সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও প্রতি মাসে ৩০-৪০টির বেশি সিলিন্ডার ডেলিভারি দিতে পারছেন না তারা। দেখা যায়, অনলাইনে হোম ডেলিভারির জন্য সিলিন্ডারপ্রতি দাম রাখা হচ্ছে ১৭ হাজার ৫শ’ টাকা থেকে ২৫ হাজার ৫শ’। এর সঙ্গে পালস অক্সিমিটার ৫ হাজার টাকাসহ মোট ৩২ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। আবার মাসিক ভাড়ায়ও মিলছে সিলিন্ডার। সেক্ষেত্রে ভাড়া ১১ থেকে ১৫ হাজার টাকা। খালি সিলিন্ডার রিফিলের খরচ ১ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/298428