১১ জুন ২০২০, বৃহস্পতিবার, ২:২৪

আমদানি কমলেও বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের ঘাটতি বাড়ছে

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারই বড় চ্যালেঞ্জ

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। ওই ধাক্কার প্রভাবে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিও। তবে সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষত লেগেছে আমাদের গায়ে। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম হওয়া সত্ত্বেও বৈদেশিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের ঋণাত্মক অবস্থা, আরো বেশি ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। এ সময় নতুন করে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বাড়তি চাপে পড়েছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। যদিও রফতানি বাণিজ্যে এপ্রিলের ভয়াবহ বিপর্যয় মে মাসে এসে অনেকটাই সামলে নেয়া সম্ভব হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারই রাষ্ট্রের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রফতানি খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে দুই হাজার ৮৭৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। বিপরীতে আমদানি বাবদ ব্যয় করেছে চার হাজার ২৯৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার। অর্থাৎ এপ্রিল শেষে দেশে বাণিজ্যঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৪২২ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় দাঁড়ায় এক লাখ ২০ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। এ সময়ে আমদানি কমেছে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। রফতানি কমেছে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ। তবে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১১ দশমিক ৭১ শতাংশ। ঘাটতির এ অঙ্ক ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময় ছিল এক হাজার ৩৯৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

যদিও করোনার কারণে রফতানিবাণিজ্যে গত এপ্রিল মাসে সৃষ্ট ক্ষত মে মাসে এসে অনেকটাই কেটেছে। চলতি অর্থবছরের মে মাসে ১৪৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬১ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং এবারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম হলেও আগের মাস এপ্রিলের চেয়ে রফতানি আয় বেড়েছে দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন গুণে। ওই মাসে রফতানি হয়েছিল মাত্র ৫২ কোটি ডলারের পণ্য। এ ক্ষেত্রে বাম্পার সাফল্য দেখিয়েছে পাট খাত। অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের মে) লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও পাটপণ্য রফতানি হয়েছে ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি। আর গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এই আয় ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেশি। শুধু তাই নয়, এই ১১ মাসে রফতানি আয় আগের পুরো অর্থবছরের আয়কে ছাড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বহির্বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকলেও সেপ্টেম্বর থেকে তা ঋণাত্মক হয়েছে। এপ্রিল শেষে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ৪.১৩ বিলিয়ন ডলার দাঁড়িয়েছে। চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসেবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। কিন্তু গত কয়েক বছর উদ্বৃত্তের ধারা অব্যাহত থাকলেও গেল অর্থবছরে ঋণাত্মক ধারায় চলে গেছে। এপ্রিলেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের এপ্রিল শেষে চলতি হিসাবে ৪১২ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণাত্মক হয়েছে, যা আগের অর্থবছরে একই সময়ে ঋণাত্মক ছিল ৫৩২ কোটি ২০ লাখ ডলার। তবে চলতি অর্থবছরে সার্বিক রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার কারণে প্রথম ১০ মাসে সামগ্রিক লেনদেনে বাংলাদেশের উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৬২ কোটি ৩০ লাখ ডলারে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে সামগ্রিক লেনদেনে ৫৯ কোটি ডলার ঘাটতি ছিল।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের মে মাসে দেশের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৪১০ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এ সময় আয় হয় মাত্র ১৪৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মে মাসের চেয়ে এই আয় ৬১ দশমিক ৫৭ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ৬৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর গত অর্থবছরের এ সময় আয় ছিল ৩৮১ কোটি ৩৩ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের জুন থেকে মে মাস পর্যন্ত গত ১১ মাসে রফতানি কম হয়েছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ শতাংশ। এ সময়ের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কম হয়েছে ২৫.৫ শতাংশ। এ সময়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার হাজার ১৫৫ কোটি ডলার। রফতানি হয়েছে তিন হাজার ৯৫ কোটি ডলারের পণ্য। গত বছরের একই সময়ে এ পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৭৭৫ কোটি ডলার।

বিশ্লেষকদের মতে, রফতানিবাণিজ্যে বড় ধাক্কার কারণে বহির্বিশ্বের সাথে বাণিজ্যঘাটতি বাড়ছে। বছরের শুরু থেকে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে লকডাউনের ফলে স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকে। অচল হয়ে পড়ে বিশ্ববাণিজ্য। এতে নেতিবাচক ধারায় থাকা দেশের রফতানি আয় ফেব্রুয়ারির পর থেকে ব্যাপক হারে কমতে থাকে। অন্য দিকে অর্থনীতি চাঙ্গা রাখার প্রধান সূচক রেমিট্যান্স আয়ও চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিলে অনেক কমে যায়। এসব কারণে বাণিজ্যে বড় ক্ষতির মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশ। তারা বলছেন, মহামারীর ফলে দেশের রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স কমছে। একই কারণে আমদানি কমার পরও চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের কারণে শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বের অর্থনীতি সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। গত মার্চ মাস থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, যার কারণে বড় বাণিজ্যঘাটতির সাথে লেনদেন ভারসাম্যেও ঘাটতি নিয়ে চলতি অর্থবছর শেষ করতে হবে বাংলাদেশকে।

রফতানি বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১১ মাসে তৈরী পোশাকের রফতানি কমেছে ১৯ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা থেকে আয় কম হয়েছে ২৬ দশমিক ৩১ শতাংশ উল্লেখ করে ইপিবি জানায়, মোট দুই হাজার ৫৭০ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে এ পরিমাণ ছিল তিন হাজার ১৭৩ কোটি ডলার। টেরিটাওয়েলসহ পোশাক খাতের সমজাতীয় পণ্য মিলে মোট রফতানিতে পোশাক খাতের অবদান ৮৬ শতাংশ। এ খাতের উদ্যোক্তাদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ মাসে মে মাসে ওভেন ও নিট খাতে পোশাক রফতানি কমেছে যথাক্রমে ১৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ ও ১৯ দশমিক ২২ শতাংশ। একই সাথে কমেছে লক্ষ্যমাত্রাও।

এ সময়ে অন্যান্য বড় পণ্যের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি কমেছে ২১ শতাংশের বেশি। লক্ষ্যমাত্রা থেকে আয় কম হয়েছে ২৬ শতাংশ। রফতানি হয়েছে মাত্র ৭৩ কোটি ৯৩ লাখ ডলারের পণ্য। গত বছরের এ সময়ে এ পরিমাণ ছিল ৯৪ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। চিংড়িসহ হিমায়িত মাছের রফতানি কম হয়েছে ১০ শতাংশ। রফতানি হয়েছে ৪২ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের পণ্য। বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্যের রফতানি কম হয়েছে ৮ শতাংশের বেশি। ৭৮ কোটি ডলারের কৃষিপণ্য রফতানি হয়েছে গত ১১ মাসে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে দেশে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে ৩৬৮ কোটি ডলার, এর মধ্যে নিট বিদেশী বিনিয়োগ ১৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের চেয়ে এফডিআই কমেছে ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ ও নিট কমেছে ২০ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। এ সময় শেয়ারবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। গত অর্থবছরেও দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ কম ছিল। এবার আরো খারাপ অবস্থায় চলে গেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে শেয়ারবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ (নিট) এসেছে মাত্র ৭০ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল এর ২০ গুণের বেশি; ১৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আলোচিত সময়ে সেবা খাতে বিদেশীদের বেতনভাতা পরিশোধ করা হয়েছে ৮৫৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আর বাংলাদেশ এ খাতে আয় করেছে মাত্র ৫৪২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এ হিসাবে ১০ মাসে সেবায় ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩১১ কোটি ১০ লাখ ডলারে, যা গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ২৬৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/507516/