করোনার চিকিৎসায় অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা ও দাম ব্যাপক বেড়েছে। মগবাজার থেকে ছবিটি তুলেছেন নূর হোসেন পিপুল
১১ জুন ২০২০, বৃহস্পতিবার, ২:২৩

অক্সিজেন সিলিন্ডারের কৃত্রিম সঙ্কট : দাম আকাশছোঁয়া

করোনা মহামারীতে হুজুগে পড়ে ঘরে ঘরে অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুদের ঘটনায় বাজারে প্রাণরক্ষাকারী এ পণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সুযোগ বুঝে সিন্ডিকেট করে দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দিয়েছে একটি মুনাফালোভী অসাধু চক্র। ১০ হাজার টাকার সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকায়। এই সুযোগে বাজার ছেয়ে গেছে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের সিলিন্ডারে। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ব্যতিরেকে নি¤œমানের এবং নির্ধারিত মাত্রার কমবেশি অক্সিজেন প্রয়োগে ঘটছে বিষক্রিয়া এবং নানা দুর্ঘটনাও। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাস মহামারীতে চাহিদা বেড়ে যাওয়া অক্সিজেনসহ পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ, মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও এসবের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের গতকাল একটি উকিল নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো: মনিরুজ্জামান লিংকন।

গতকাল বুধবার সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতালগুলোতে কয়েক গুণ চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে সাধারণ নাগরিকেরাও ঘরে ঘরে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে অক্সিজেন কিনে মজুদ রাখছেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ১.৩৬ মিটার কিউব গ্যাস ধারণক্ষমতার সিলিন্ডার। সুযোগ বুঝে একটি অসাধু চক্র সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে ১০ হাজার টাকার অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম নিচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। হাসপাতালগুলো চিকিৎসা নিয়ে গড়িমসি করায় অনেকে অক্সিজেন কিনে বাসায় রাখছেন। এই সুযোগে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে বাড়তি দাম আদায় করছে চক্রটি।

ভুক্তভোগীরা জানান, দিন যত যাচ্ছে দেশের হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে করোনা রোগীর চাপ। রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো। এ অবস্থায় যেসব রোগীর শারীরিক অবস্থা কিছুটা ভালো তাদের বাড়িতে থেকেই নিয়ম মেনে চিকিৎসা নিতে উদ্বুদ্ধ করছেন চিকিৎসকরা। কিন্তুবাড়িতে থাকা রোগীরা অতিরিক্ত সচেতনতা হিসেবে নির্ভর করছেন অক্সিজেন সিলিন্ডারের ওপর। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে অন্তত একটি সিলিন্ডার রাখতে চাচ্ছেন বাড়িতে। ফলে সারা দেশে অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য তৈরি হয়েছে বাড়তি চাহিদা।

জানা যায়, বাংলাদেশে অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে বোতলজাত অক্সিজেন ও অন্যান্য গ্যাসীয় পদার্থের ব্যবসার সাথে যুক্ত রয়েছে লিন্ডে গ্রুপ। দেশীয় প্রতিষ্ঠান ইসলাম গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপসহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠান এই ব্যবসায় যুক্ত। যদিও গ্যাসের বোতল অনেকটাই আমদানিনির্ভর। অক্সিজেন সিলিন্ডারবিডি, অক্সিজেনবিডি, মেডিশপ ডটকম, লিন্ডে ডটকমডটবিডি, সিসমার্ক লিমিটেডসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট এবং কিছু ফেসবুকভিত্তিক অক্সিজেন সরবরাহ করলেও গত এক সপ্তাহেও সংরক্ষণের জন্য একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার কোথাও পাননি বলে জানান একাধিক ভুক্তভোগী।

বাড়তি চাহিদার কারণে হিমসিম খাওয়ার পরিস্থিতি জানিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অক্সিজেন সিলিন্ডারবিডির ব্যবস্থাপক আল ইমরান রুবেল বলেন, অক্সিজেন সিলিন্ডারের খোঁজে তার প্রতিষ্ঠানের দু’টি মোবাইল নম্বরে দিন-রাত অনবরত ফোন আসছে। কিন্তু পাঁচ দিন ধরে নতুন করে কোনো অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি কিংবা ভাড়া দিতে পারছি না। কারণ যেগুলো মজুদ ছিল তা ইতোমধ্যেই বিক্রি বা বুকড হয়ে গেছে। তিনি বলেন, অনেকে বাসায় সংরক্ষণের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার চাচ্ছেন। অনেকে আবার শ^াসকষ্টে পড়ে জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন চাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে অনেকে ফোন করে রীতিমতো হাহাকার করছেন। কিন্তু আমাদের এ মুহূর্তে কিছুই করার থাকছে না। কারণ পাঁচ দিন আগেই স্টক ফাঁকা হয়ে গেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই জেনেও অনেক ক্রেতা জোর করে টাকা জমা দিয়ে গেছেন। তিনি জানান, বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেন সিলিন্ডারের সঙ্কটে পড়েছেন সবাই। প্রায় পাঁচ গুণ দাম বেড়ে মাঝারি মানের একটি অক্সিজেনের সিলিন্ডার ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম বিক্রি হচ্ছে ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। অথচ তিন মাস আগেও অক্সিজেন সিলিন্ডারের এই সেট পাওয়া যেত ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায়।

এ দিকে চলমান করোনাভাইরাস মহামারীতে বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুদ না করার পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কারণ অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে ঘটতে পারে ভয়াবহ বিপদ। গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত অনলাইন বুলেটিনে এই পরামর্শ দেন অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) প্রফেসর নাসিমা সুলতানা। তিনি বলেন, এটি একটি টেকনিক্যাল বিষয়। দয়া করে এগুলো (অক্সিজেন সিলিন্ডার) কিনে বাড়িতে মজুদ করবেন না। এটা বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করবে। প্রফেসর নাসিমা আরো বলেন, একজন রোগীর প্রতি মিনিটে কতটুকু অক্সিজেন প্রয়োজন, তা কেবল একজন চিকিৎসকই বলতে পারেন। এ ধরনের কাজের মাধ্যমে জীবনের ঝুঁকি ডেকে না আনতে সবার প্রতি পরামর্শ দেন তিনি।

এ দিকে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহারে দেখা দিচ্ছে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকির। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাড়তি চাহিদায় সরবরাহকৃত সিলিন্ডারের সাথে থাকা মাস্ক এবং পাইপের মান নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। তারা জানান, করোনা রোগীদের জন্য প্রয়োজন উচ্চ চাপসমৃদ্ধ অক্সিজেন। কিন্তু এখন শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে করোনা রোগীদের জন্য। এই সিলিন্ডারে অক্সিজেনের পরিমাণ কত আছে, তা জানার সুযোগ নেই। ফলে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যেই মাঠে নেমেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/507493/