১১ জুন ২০২০, বৃহস্পতিবার, ২:২১

'অক্সিজেন' নিয়েও সিন্ডিকেট

কারসাজিতে জড়িত চট্টগ্রামের ১৫ প্রতিষ্ঠান

করোনার এই মহামারিতে গুরুতর অসুস্থ রোগীকে বাঁচানোর গুরুত্বপূর্ণ একটি মেডিকেল উপাদান অক্সিজেন সিলিন্ডার। কিন্তু এই সিলিন্ডারকে হাতিয়ার করে অসহায় মানুষের পকেট কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ১৫ প্রতিষ্ঠানের একটি সিন্ডিকেট। ১২২ টাকার রিফিলে তারা মুনাফা করছে এক হাজার টাকারও বেশি। আবার সাত হাজার টাকা দামের সিলিন্ডারে তারা লাভ করছে প্রায় ২০ হাজার টাকা।

এসবের কোনো প্রমাণ না রাখতে সিন্ডিকেট সদস্যরা অনেকেই রসিদে বিক্রিকালীন দাম লিখছেন না। সিলিন্ডার বিক্রি করতে তারা তৈরি করেছেন এক পেপারলেস মার্কেট। প্রশাসনের কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানও এই কারসাজির খেলায় নেমে লুটছে মুনাফা।

শুধু তাই নয়, মেডিকেল সিলিন্ডারে এই সিন্ডিকেট যে অক্সিজেন দিচ্ছে, তাতে নেই কাঙ্ক্ষিত মাত্রার ঘনত্ব। বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হওয়া কম ঘনত্বের অক্সিজেনকে তারা বিক্রি করছেন মেডিকেলের অক্সিজেন হিসেবে। এসব অক্সিজেন জমা করাও হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ সিলিন্ডারে। চিকিৎসকরা বলছেন, এর ফলে রোগীকে বাঁচানোর জন্য এসব সিলিন্ডারের ব্যবহারও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে কারসাজির এই সিন্ডিকেটে রয়েছে চট্টগ্রামের হাসান ট্রেডার্স, মেসার্স ব্রাদার্স প্রকৌশল ওয়ার্কশপ, বিছমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ ও জিলানি অক্সিজেন লিমিটেড। জেলা প্রশাসনের তদন্তে এদের সহযোগী হিসেবে পাওয়া গেছে পাঁচলাইশের শহীদ এন্টারপ্রাইজ, মেডিকেলের সামনে ব্যবসা করা সৌদিয়া এন্টারপ্রাইজ, সাহান মেডিকো/বিকে ফার্মেসি, হীরা মেডিকো, জে কে এন্টারপ্রাইজ, কে-কোবরা, তাজ সায়েন্টিফিক মার্ট এবং এবি সার্জিক্যালকে। চট্টগ্রাম শহর থেকে অক্সিজেন নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহকারী এই সিন্ডিকেটে রয়েছে কক্সবাজারের গাউসিয়া এন্টারপ্রাইজ, দক্ষিণ চট্টগ্রামের বেলায়েত এন্টারপ্রাইজ ও ফেনীর তুহিন এন্টারপ্রাইজ। যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে বাণিজ্যিক অক্সিজেন নিয়ে মেডিকেল অক্সিজেন হিসেবে বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছে সেগুলোর মধ্যে আছে সীমা এন্টারপ্রাইজ, মদিনা এন্টারপ্রাইজ, এয়ার গ্যাস, গোল্ডেন অক্সিজেন ইন্ডাস্ট্রিজ ও জিডি সুবেদার ইন্ডাস্ট্রিজ।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ফোকাল পার্সন ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুর রব মাসুম বলেন, 'শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীর জন্য অক্সিজেন গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল উপাদান। এটি পরিচালনা করতে হয় খুব সতর্কতার সঙ্গে। এর জন্য এমন সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হয়, যেটিতে অক্সিজেনের গুণগত মানও অক্ষুণ্ণ থাকে। বাণিজ্যিক অক্সিজেনে ঘনত্ব থাকে সাধারণত ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। কিন্তু এক দশমিক চার কিউবিক লিটার মেডিকেলের অক্সিজেন সিলিন্ডারে ঘনত্ব থাকে ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশের কাছাকাছি। কাঙ্ক্ষিত মাত্রার ঘনত্ব থাকলে রোগী অক্সিজেন থেকে উপকারও পায় বেশি।'

জরুরি এই সময়ে অক্সিজেনের বেসামাল বাণিজ্য প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেন, 'সিন্ডিকেট করে যারা ওষুধ, অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম বাড়াচ্ছে, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মাঠে আছেন। একদিনে দুটি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা জরিমানাও করেছেন তারা। এই চক্রে কারা আছে, সে সম্পর্কে আরও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।'

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশে মেডিকেল গ্রেড পিউরিটির অক্সিজেন প্রস্তুতকারক বৈধ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি যৌথ মালিকানার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান লিন্ডে বাংলাদেশ, বেসরকারি মালিকানাধীন স্পেকট্রাম অক্সিজেন লিমিটেড ও নারায়ণগঞ্জের ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড। দেশের কোথাও এসব কোম্পানির কোনো ডিলার নেই। হাসপাতালে থাকা প্লান্টে তারা নিজেরাই অক্সিজেন সরবরাহ করে। ডাক্তারের চিকিৎসাপত্র ও এনআইডি কার্ড থাকলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিংবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে তারা এক দশমিক চার কিউবিক বা এক হাজার ৪০০ লিটারের অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রয় করেন। তাদের সিলিন্ডার যথাযথ মান রক্ষা করেই বানানো হয়। কিন্তু অসাধু চক্র বাণিজ্যিক সিলিন্ডারে মেডিকেল অক্সিজেন ভরে বিক্রি করছে।

তিনি জানান, বাণিজ্যিকভাবে অক্সিজেন উৎপন্নকারীদের একাংশের সঙ্গে যোগসাজশে তারা এটি করছে। এই চক্রের কেউ কেউ লিন্ডের ডিলার হিসেবে নিজেদের মিথ্যা পরিচয় দিচ্ছে। লিন্ডের নামে প্যাড তৈরি করে সেটি রসিদ হিসেবে ব্যবহার করছে। ঝামেলা এড়াতে সিন্ডিকেটের সদস্যরা নথিপত্রে কোনো প্রমাণ রাখছে না। প্রতি সিলিন্ডারে চার থেকে ছয় গুণ বাড়তি মুনাফাও করছে তারা। এসব অভিযোগে বিছমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজকে গত ৯ জুন চার লাখ টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ওমর ফারুক। এর আগে কালো তালিকাভুক্ত করেও জরিমানা করা হয়েছে ব্রাদার্স প্রকৌশলকেও। চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে সিলিন্ডার সরবরাহ করার সময় মিটার টেম্পারিং করায় বিছমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজকে ২০১৬ সালে কালো তালিকাভুক্তও করে লিন্ডে বাংলাদেশ। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিছমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজের ব্যবহূত প্যাডে এখনও তাদের ইসলাম এন্টারপ্রাইজের ডিলার হিসেবে উল্লেখ করা আছে।

জানতে চাইলে বিছমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ শহীদ জানান, ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতেই এসব অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামের ১১টি বেসরকারি হাসপাতালে রাত-বিরাতে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করছেন তিনি। এই দুঃসময়ে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সিলিন্ডারের দাম নিয়ে অস্থিরতা রয়েছে এটা ঠিক, কিন্তু মিটার টেম্পারিংয়ের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে কেউই করতে পারবে না। তিনি বলেন, 'অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবসাই শুধু আমি করছি না। বড় বড় আরও অন্তত ৩০টি প্রতিষ্ঠান আছে সারাদেশে।' প্যাডে নিজেকে ডিলার পরিচয় দেওয়ার বৈধতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, 'এগুলো পুরোনো প্যাড। নতুন প্যাডে এটির উল্লেখ নেই।' অভিযুক্ত আরেক প্রতিষ্ঠান ব্রাদার্স প্রকৌশলের নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও তারা কেউ রিসিভ করেননি।

এদিকে চট্টগ্রামের সাগরিকায় লিন্ডে বাংলাদেশের কারখানা পরিদর্শনকালে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে প্লান্ট প্রকৌশলী শাহাদাত হোসেন জানান, মেডিকেল অক্সিজেন থাকা সিলিন্ডার খুব স্পর্শকাতর। এগুলো উৎপাদন ও সংরক্ষণে নানা সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হয়। বাণিজ্যিক সিলিন্ডারে অতটা কঠোরভাবে মানের বিষয়টি দেখে না সবাই। যেসব উপাদান দিয়ে সিলিন্ডার তৈরি হয় সেগুলো যথাযথভাবে আগে সংরক্ষণও করতে হয়। কত ডিগ্রি তাপমাত্রায় সিলিন্ডারের গুণগত মান অক্ষণ্ণ থাকে সেটিও জানা জরুরি। সিলিন্ডারের সঙ্গে থাকা ক্যাপও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানোত্তীর্ণ না হলে অক্সিজেন লিকেজ হওয়ারও শঙ্কা থাকে। তিনি জানান, রোগীর স্বজনরা বাজার থেকে এখন যেসব অক্সিজেন সিলিন্ডার ঘরে নিচ্ছেন, সেগুলোতে মান কতটা আছে, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে।

https://samakal.com/whole-country/article/200626337