১৯ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৮:৩৭

অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত বেসিক ব্যাংক

হিসাব খোলার আগেই ঋণ অনুমোদন

অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে ১৭ অনিয়ম

গ্রাহক ব্যাংক হিসাব খোলেননি, তার আগেই তাদের অনুকূলে ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে। এমনকি পরিচালনা পর্ষদে উত্থাপন না করেই বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কোনো রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কেবল চেয়ারম্যানের ক্ষুদ্র নোটে নিয়োগ দেয়া হয়েছে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। এ রকম প্রায় ১৭ রকম অনিময় হয়েছে বেসিক ব্যাংকে। সম্প্রতি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে পাঠানো এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।


বেসিক ব্যাংকের অনিয়মের সাথে তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান, পরিচালকবৃন্দ এবং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অধিকাংশ ঋণ কোনোরূপ যাচাই-বাছাই ছাড়া অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবেদনের দু-এক দিনের মধ্যেই, অনুমোদন করা হয়েছে। এমনকি গ্রাহকের হিসাব খোলার আগেই ঋণ অনুমোদিত হিসেবে পর্ষদের কার্যবিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দিয়াজ হোটেল ও রিসোর্ট কর্তৃক ২০১২ সালের ২৭ মার্চ ব্যাংকের গুলশান শাখায় হিসাব খোলা হয় এবং ঠিক তার পরদিন ২৮ মার্চ পর্ষদ কর্তৃক ঋণপ্রস্তাবটি অনুমোদন করা হয়। অন্য দিকে, মেসার্স অটো ডিফাইনের ঋণ হিসাব খোলা হয় ২০১০ সালে ৩ নভেম্বর। অথচ ঋণ প্রস্তাবটি অনুমোদন দেয়া হয় তার আগের দিন ২ নভেম্বর।’


বেসিক ব্যাংকের অনিয়মের বিবরণ দিয়ে ব্যাংকিং বিভাগের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, শাখা ঋণ কমিটি ও প্রধান কার্যালয়ের ঋণ কমিটি ঋণ মঞ্জুরির বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য দেয়ার পরও তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক ১৮৭টি গ্রাহকের অনুকূলে সর্বমোট ৫ হাজার ৯৯৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে গুলশান শাখার গ্রাহক মেসার্স টেকনো ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ঋণ মঞ্জুরির বিষয়ে শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটির নেতিবাচক অভিমত থাকা সত্ত্বেও ঋণপ্রস্তাবটি পর্ষদ সভায় ২০১২ সালে ৩১ জুলাই অনুষ্ঠিত ৩১৪তম সভায় অনুমোদিত হয়।’


ব্যাংকিং বিভাগের প্রতিবেদনে এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৭(কক) স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ‘কোনো খেলাপি ঋণ গ্রহীতার অনকূলে কোনো ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোনোরূপ ঋণসুবিধা প্রদান করিবে না।’ বিষয়টি প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটির মতামত ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের স্মারকলিপিতে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকার পরও পর্ষদ কর্তৃক একাধিক খেলাপি ঋণ গ্রহীতার অনুকূলে ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে।


এই যখন অবস্থা তখন শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন এই ব্যাংকের ৫৪ ভাগ ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে।
এর আগে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বেসিক ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়মের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছিল। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রধান কার্যালয়ের ঋণ যাচাই কমিটি বিরোধিতা করলেও বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সেই ঋণ অনুমোদন করেছে। ৪০টি দেশীয় তফসিলি ব্যাংকের কোনোটির ক্ষেত্রেই পর্ষদ কর্তৃক এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয় না। পর্ষদের ১১টি সভায় ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে তিন হাজার ৪৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, যার অধিকাংশ ঋণই গুরুতর অনিয়ম সংঘটনের মাধ্যমে করা হয়েছে। এই ঋণ পরিশোধ বা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেও মত দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ইতোমধ্যে দুর্নীতির কারণে ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক ২০০৯ সাল পর্যন্ত একটি লাভজনক ব্যাংক ছিল। কিন্তু এরপর যখন রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুকে নিয়োগ দেয়া হয় তখন থেকেই ব্যাংকটির আর্থিক অনিয়মের সূত্রপাত হয়। চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের প্রত্যক্ষ মদদে বেসিক ব্যাংকে একে একে ঘটে যায় অনেকগুলো আর্থিক কেলেঙ্কারি। পরে সরকারের শীর্ষমহলের নির্দেশে বাচ্চুকে সম্মানজনকভাবে ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।


বেসিক ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুনীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকে মামলা করা হলেও ব্যাংকর সাবেক চেয়ারম্যান এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/204812