১৯ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৮:৩৬

পানিবাহিত রোগের প্রকোপ

বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট

রাজধানীর কে এম দাস লেনের ২৬ নম্বর বাসার মালিক আশিক ইলাহির ছেলে সম্প্রতি অ্যালার্জিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসকেরা জানান, পানিবাহিত কারণে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে সে। আশিক ইলাহি বলেন, ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানি পান করে তার ছয় তলা ভবনের অনেকেরই ডায়রিয়া হয়েছে। তিনি নিজেও পেটের পীড়ায় ভোগেন কিছুদিন। এ ছাড়া ভবনের অনেকেই চর্মজাতীয় নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। শুধু কে এম দাস লেনই নয়, রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকার বাসিন্দারাই পানিবাহিত নানা রোগে ভুগছেন। গত দুই দিন বৃষ্টির কারণে আবহাওয়া কিছুটা ঠাণ্ডা থাকলেও এর আগে প্রায় দেড় মাস ধরে বেশ গরম পড়েছে। এ কারণে পানিবাহিত রোগের প্রকোপও বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। মূলত ওয়াসার সরবরাহ করা দুর্গন্ধযুক্ত পানি থেকে এ রোগ ছড়াচ্ছে। এ ছাড়া রাস্তা থেকে পানিমিশ্রিত আখের রস, লেবুর শরবতের মতো ঠাণ্ডা পানীয় ও খাবার খেয়েও অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।


মগবাজার নয়াটোলার বাসিন্দা নিজাম উদ্দীন বলেন, গত দেড় মাস ধরে নয়াটোলা এলাকায় ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। পানির রঙ কখনো লালচে আবার কখনো কালো দেখা যায়। এ পানি খাওয়া দূরের কথা, গোসল ও কাপড় পরিষ্কার করলেও তাতে দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। এ পানি ব্যবহার করায় শিশুরা ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এ ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে অনেকে বাজার থেকে পানি কিনে খাচ্ছেন। এ জন্য প্রতি মাসে ২০০-৩০০ টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বিষয়টি ওয়াসার কর্মকর্তাদের জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। ওয়াসার কর্মকর্তারা বলছেন, শীতলক্ষ্যার পানি শোধন করে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। কিন্তু এখন পানির স্তর নেমে যাওয়ায় বেশি ওষুধ ব্যবহার করতে হচ্ছে। এ কারণে দুর্গন্ধ হচ্ছে।


মীরবাগের বাসিন্দা আজিজুর রহমান কাজল বলেন, গত দেড় মাস ধরেই মীরবাগ ও মধুবাগ এলাকার পানিতে দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে ছেলেমেয়েরা পেটের পীড়ায় ভুগছে। মধুবাগের ওয়াসার পানির পাম্প বন্ধ থাকায় সেখান থেকেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন কোম্পানির সরবরাহ করা জার পানি কিনে খাওয়া, রান্না ও গোসলের কাজ করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ওয়াসা অফিসে গিয়ে অভিযোগ দিয়ে আসার পরও কোনো সুরাহা হয়নি। এলাকার হাজার হাজার মানুষকে দিনের পর দিন চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।


রাজধানীর কল্যাণপুর ইবনে সীনা হাসপাতালের চিকিৎসক মেজর (অব:) আনোয়ার হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, পানিবাহিত কারণে ডায়রিয়া, টাইফয়েড, আমাশয়, জন্ডিসসহ সমজাতীয় সংক্রামক নানা রোগ সৃষ্টি হয়। বড়দের চেয়ে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। এ কারণে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়। তিনি বলেন, যখন গরম বেড়ে যায় তখন এ জাতীয় রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। এ অবস্থায় রোগীদের আমরা যতদূর সম্ভব বিশুদ্ধ পানি পান করার চেষ্টা করার এবং নষ্ট-বাসি খাবার না খাওয়ার পরামর্শ দিই।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বিশ্বে প্রতি বছর ১৮ কোটি মানুষ পানিবাহিত রোগে মারা যায়। বিশেষত ডায়রিয়ার কারণে শিশুমৃত্যু হার অনেক বেশি। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শিশুরা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয় সবচেয়ে বেশি। সময় মতো এ থেকে সাবধান না হলে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তুর বিভিন্ন রোগের জন্য প্রধানত দায়ী রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব (ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস) এবং কয়েক রকমের পরজীবী। এ ধরনের সংক্রামক রোগসৃষ্টিকারী অণুজীবেরা নানা রকম কৌশলের সাহায্যে পরিবেশে বেঁচে থাকে বা বিস্তার লাভ করে। বিস্তার লাভের জন্য তিনটি প্রধান পন্থা হচ্ছে : বাতাস, পানি এবং শারীরিক সংস্পর্শ। শ্বাসনালীর মাধ্যমে দেহে প্রবেশের জন্য বাতাসই মাধ্যম রূপে কাজ করে। অপর পক্ষে পরিপাকতন্ত্রের সংক্রমণের মাধ্যম হলো পানি। অনেক সংক্রামক, উদাহরণস্বরূপ ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করতে পাকস্থলীকে পথ হিসেবে ব্যবহার করে এবং দ্রুত অভীষ্ট অঙ্গে পৌঁছে পাকস্থলীকে পরিত্যাগ করে।
পানিবাহিত যত রোগ : চিকিৎসকদের মতে, বেশ কিছু রোগ প্রধানত পানির মাধ্যমে ছড়ায় অথবা দূষিত পানির কারণে হয়। আর্সেনিক দূষণ : পানিতে মিশে থাকা অতিমাত্রায় আর্সেনিকের কারণে এ রোগ দেখা দেয়। ত্বকের, হৃদপিণ্ডের, লিভার এবং কিডনির সমস্যা এ আর্সেনিক দূষণ বা আর্সেনিকোসিস থেকে হতে পারে।


কৃমি : কৃমির আক্রমণ অন্যতম প্রধান পানিবাহিত রোগ।


কলেরা : এটি একটি পানিবাহিত মারাত্মক রোগ। এটি জীবাণুর কারণে হয়। দূষিত জীবাণুযুক্ত পানি পান করলে কলেরা হয়ে থাকে। পাতলা পায়খানার সাথে প্রচুর বমি কলেরার লক্ষণ।


ডায়রিয়া : বাংলাদেশে অন্যতম ঘাতক এ পানিবাহিত রোগটি। পানিতে মিশে থাকা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্রোটেজোয়া প্রভৃতি জীবাণুর কারণে ডায়রিয়া হয়ে থাকে।


হেপাটাইটিস : এটি একটি পানি বাহিত ভাইরাসজনিত রোগ। এর ফলে জন্ডিস হয়ে থাকে। এটি লিভারকে নষ্ট করে ফেলতে পারে। জন্ডিসের ফলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।


পোলিও : এটি ছোটদের একটি মারাত্মক রোগ। এটিও পানিবাহিত রোগ।
টাইফয়েড : এটিও পানিবাহিত রোগ। সলমনেলা টাইফি এবং প্যারাটাইফি নামক পানিবাহিত জীবাণুর কারণে এ রোগটি হয়ে থাকে।


খোসপাঁচড়া : ত্বকের পানিবাহিত রোগ। দূষিত পানির সংস্পর্শে খোসপাঁচড়া, চুলকানিসহ ত্বকের নানা রোগ হয়।
এগুলো ছাড়াও পরোক্ষভাবে আরো কিছু রোগের জন্য পানি দায়ী। যেমন- ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি। তাই যেভাবেই হোক ভালো থাকার জন্য সব সময় বিশুদ্ব পানি পান করতে হবে।


প্রতিরোধে করণীয় : চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, বিশুদ্ধ পানি পান করার মাধ্যমে এ সমস্যা থেকে সহজে রেহাই পাওয়া যায়। এ জন্য ফোটানো বা বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। পরিষ্কার পাত্রে পানি সংরক্ষণ করতে হবে। খাবার তৈরি এবং খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধুয়ে নিতে হবে। এ নিয়ম শিশুদের ক্ষেত্রে আরো বেশি করে কার্যকর করতে হবে। তাদের ছোটবেলাতেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা দিতে হবে। ওয়াশরুম ও পায়খানা থেকে বের হওয়ার আগে হাত অবশ্যই ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। রান্নার আগে খাবার ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। বাইরে-রাস্তায় খাওয়া-দাওয়া না করে ঘরে বসে ঘরের খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/204796