৮ জুন ২০২০, সোমবার, ১১:০৬

সমন্বয়হীন কাজে ঢিলেঢালা তিন মাস

দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার আজ তিন মাস পূর্ণ হলো। তিন মাস ছিল গুরুত্বপূর্ণ সময়। সময়টা পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি। অনেকটা উদ্দেশ্যহীন, পরিকল্পনাহীন ও সমন্বয়হীন কাজের মধ্য দিয়ে মহামারির তিন মাস পার করেছে বাংলাদেশ। আগামী তিন মাসে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে গভীর সংশয় মানুষের মনে।

তিন মাস আগে ৮ মার্চ নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেদিন মৃত্যুর খবর ছিল না। এত দিনে ‘সংবাদ ব্রিফিং’ নাম বদলে হয়েছে ‘সংবাদ বুলেটিন’। অন্যদিকে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় এসেছে বড় পরিবর্তন। গতকাল রোববার নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, দেশে নতুন ২ হাজার ৭৪৩ জন করোনায় আক্রান্ত। ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু ৪২।

প্রতিদিনের আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যানে মানুষ অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। যদিও সংক্রমণের ভয় তাড়া করে চলেছে দেশের মানুষকে। মানুষ অস্বস্তিতে আছে, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। মৃত্যু আর আক্রান্তের পরিসংখ্যান কোথায় গিয়ে শেষ হবে, মানুষ বুঝতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, সংক্রমণের বর্তমান ধারা মাসের শেষ পর্যন্ত থাকবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত তিন মাসে আমরা অনেক কিছুই করেছি। কিন্তু প্রতিটি কাজই করেছি ঢিলেঢালাভাবে। সামনে চূড়ান্ত পরীক্ষার সময়—এমন বিবেচনা করে সবকিছু আঁটসাঁটভাবে করতে হবে। ফাঁক রাখা যাবে না।’

করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের কাজে শুরু থেকেই ঢিলেঢালা ভাব দেখা গেছে। প্রবাসীদের কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) রাখা নিয়ে গোলযোগ, রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার আওতা বাড়ানো নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা, কনট্যাক্ট ট্রেসিং (আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত) অব্যাহত না রাখা, হাসপাতাল নির্বাচন ও প্রস্তুতিতে সময় নষ্ট, জনবল নিয়োগে বিলম্ব, ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর মান ও বিতরণে অনিয়ম, চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণে ঘাটতি, কোভিড ও নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় সমন্বয়হীনতা—এ রকম অনেক ক্ষেত্রেই অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে এরই মধ্যে স্বাস্থ্যসচিবসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে বদলিও করেছে সরকার।

অভিযোগ আছে, ঠিক কাজকে সঠিক সময়ে গুরুত্ব দেয়নি সরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা যেমন তাদের নজরে পড়েনি, তেমনি বিশেষজ্ঞদের মতামতও আমলে নেয়নি। উদাহরণ হিসেবে প্রথমেই সামনে চলে আসে নমুনা পরীক্ষার বিষয়। দেশে নমুনা পরীক্ষা শুরু হয়েছিল জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে। ৮ মার্চ পর্যন্ত মাত্র ১২৭টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছিল বলে একটি গবেষণা সূত্র জানিয়েছে। পরীক্ষার নিয়ন্ত্রণ এককভাবে আইইডিসিআরের হাতে ছিল। এখন ৫২টি কেন্দ্রে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। যদিও দিনে ১৫ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দৈনিক কমপক্ষে ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা হওয়া দরকার। কোন উদ্দেশ্যে আইইডিসিআর পরীক্ষার আওতা বাড়াতে চায়নি, তা আজও কেউ জানে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিকে পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত করা যেমন জরুরি, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা অন্য মানুষদের খুঁজে বের বরা, সন্দেহভাজনদের কোয়ারেন্টিন করা বা নজরদারিতে রাখা। কনট্যাক্ট ট্রেসিং ও কোয়ারেন্টিন দুটো কাজই ঠিকমতো হয়নি। এখনো হচ্ছে না।

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজধানীর টোলারবাগে বা মাদারীপুরের শিবচরে কনট্যাক্ট ট্রেসিং ও কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা সঠিক ও সফল ছিল। সেই সফল উদাহরণ থেকেই আমাদের শিক্ষা নেওয়া দরকার ছিল।’

তবে অনেকে দাবি করেন, সংক্রমণ প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারটিতে বাংলাদেশ গুরুত্ব দিয়েছিল মোটামুটি ঠিক সময়ে। ২৬ মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এরপর সরকার কয়েক দফায় ছুটি বাড়িয়েছে। পোশাক কারখানার পাশাপাশি অন্য কারখানা খুলে দেওয়া, লকডাউন (অবরুদ্ধ পরিস্থিতি) শিথিল করা, গণপরিবহন চালু করা—সরকারের এসব সিদ্ধান্ত মানুষের কাছে মিশ্র বার্তা দিয়েছিল। কেউ কেউ জীবিকার অজুহাত সামনে এনে স্বাস্থ্যবিধি এড়িয়ে গেছেন। বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, এখন এটা পরিষ্কার যে এসব কাজ হয়েছিল যথেষ্ট পূর্বপ্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ছাড়াই।

করোনা প্রতিরোধের কাজে যেমন নানা কমতি ছিল, তেমনি ঘাটতি দেখা গেছে চিকিৎসার ক্ষেত্রেও। করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য রাজধানীতে ১২টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে নির্দিষ্ট করা আছে। এ ছাড়া আট বিভাগে আছে আরও ৬৪টি হাসপাতাল। এসব হাসপাতালে শয্যা প্রায় ১৪ হাজার। এরই মধ্যে সরকার ২ হাজার চিকিৎসক ও ৩ হাজার নার্স নিয়োগ দিয়েছে। আর ৩ হাজার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। চিকিৎসা নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। অভিযোগ উঠেছিল, হাসপাতালে করোনা রোগীদের সেবায় ঘাটতি আছে। শুরুর দিকের সেই অভিযোগ এখন অনেকটাই কমে এসেছে। তবে করোনা রোগী নয় এমন সাধারণ রোগীর চিকিৎসার বিষয়টি এখনো জটিল অবস্থার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। করোনা নেই এমন সনদ দেখাতে না পারলে তীব্র পেটে ব্যথা বা চোখের অসুখেও মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে না। চিকিৎসার আশায় সরকারি–বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে একাধিক মৃত্যুর ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। কোনো ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা যায়নি। এত ঘটনার পরও সেবার ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ এখনো আছে।

স্বাস্থ্য খাতের এই অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ ও মৃত্যুর পরিসংখ্যানের মধ্যেও আত্মতুষ্টির কথা শোনা যায় সরকারের মন্ত্রীদের মুখে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ২১ মার্চ ধানমন্ডির এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী।’ আরও আগে ৩ মার্চ সচিবালয়ে এক সভা শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে কোনোভাবে করোনাভাইরাস চলে এলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা আগে থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে আছি।’

বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। খুব কমসংখ্যক করোনা রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। হাসপাতালে এখনো জনবলের সংকট যেমন আছে, তেমনি আছে অক্সিজেনের স্বল্পতা। খুব সামান্য সংখ্যক রোগী আইসিইউ সেবা নিতে পারছেন। ৪০ হাজারের বেশি রোগী নিজ দায়িত্বে বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এঁদের মধ্যে অনেকে বাড়িতেই মারা যাচ্ছেন। গতকাল যে ৪২ জনের মৃত্যুর খবর ঘোষণা করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে বাড়িতে। এ ছাড়া আরও ৯০০–এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে করোনা উপসর্গ নিয়ে। এঁদের কারও মৃত্যু হয়েছে বাড়িতে, কারও গাড়িতে, রাস্তায়, কারও এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে নেওয়ার পথে, কারও নিজের বাড়ির সিঁড়িতে।

এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে কয়েকজন জনস্বাস্থ্যবিদ দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে প্রক্ষেপণ বা প্রজেকশন করেছিলেন এবং একটি অনুমিত হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে দিয়েছিলেন। পোশাক কারখানাসহ অন্যান্য কারখানা খুলে দেওয়া, লকডাউন শিথিল করা বা তুলে নেওয়া এবং সবকিছু প্রায় উন্মুক্ত করার বিষয়গুলো জনস্বাস্থ্যবিদদের বিবেচনায় ছিল না। তাই তাঁদের হিসাবকে ভুল প্রমাণ করে দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েই চলেছে। এঁদের একজন গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেছেন, বিশেষ কোনো উদ্যোগ না নিলে সংক্রমণ ও মৃত্যুর এই ধারা জুলাইয়ের শুরু পর্যন্ত অব্যাহত থাকার আশঙ্কা আছে। তাঁদের সর্বশেষ প্রক্ষেপণ বলছে, জুনের মাঝামাঝি আক্রান্তের সংখ্যা হবে ৮৭ হাজার এবং জুনের শেষ পর্যন্ত এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ১ লাখ ২৩ হাজারে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে স্থিতিশীল অবস্থা শুরু হতে পারে। থাকবে প্রায় দুই সপ্তাহ। এরপর সংক্রমণ ধীরে ধীরে কমতে থাকবে।

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আপনা-আপনি এই মহামারির প্রচণ্ডতা কমবে না। সম্ভাব্য সব ধরনের উদ্যোগ নিয়ে প্রচণ্ডতা কমাতে হবে। এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ‘ঘনীভূত মহামারির বিস্ফোরণ’ বন্ধ করা। বড় শহরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যেন সংক্রমণ না ছড়ায়, সে ব্যাপারে জরুরি বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুন করে লকডাউনের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক।

https://www.prothomalo.com/bangladesh/article/1661349/