১৮ মার্চ ২০১৭, শনিবার, ১০:১৬

পড়ে যাওয়া গার্ডারটি অরক্ষিত অবস্থায়

মৌচাক মালিবাগ রাজারবাগে উড়ালসড়কের নিচে দুর্ভোগ

মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়ক নির্মাণস্থলের সড়কগুলো এখন আরও বেশি বেহাল। কোথাও প্রায় পুকুর হয়ে আছে। কোথাও ধুলায় ধূসরিত। নয় কিলোমিটার দীর্ঘ মগবাজার-মৌচাক উড়ালসড়ককে কেন্দ্র করে প্রায় চার বছর ধরে মানুষের যে অসহনীয় দুর্ভোগ, তা আর কত দিন চলবে কেউ জানে না।
গত দুদিন মৌচাক, মালিবাগ ও রাজারবাগ এলাকা ঘুরে এই অবস্থা দেখা গেছে। শ্রমিকেরা উড়ালসড়কের কিছু অংশে এখনো ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। ১৩ মার্চ মালিবাগ রেলগেটের কাছে গার্ডার (কলামের ওপর থাকা যাবতীয় চাপ বহনকারী রড-সিমেন্টের কাঠামো) তোলার সময় দুর্ঘটনায় একজন শ্রমিক নিহত হন। সহকারী প্রকৌশলীসহ আহত হন দুজন। পরে আহত ব্যক্তিদের পা কাটতে হয়। গত বৃহস্পতিবার দেখা গেল, ওই দুর্ঘটনার বিষয়ে শ্রমিকদের অনেকেই নির্লিপ্ত। একজন শ্রমিককে দেখা গেল, হলুদ রঙের একটি লোহার টুপি হাতে নিয়ে অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলছেন। গতকাল শুক্রবার সকালে এলাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রকৌশলী বা তত্ত্বাবধায়ককে পাওয়া যায়নি।
তমা কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান অবশ্য প্রথম আলোকে বলেছেন, আগামী জুনের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। তবে এই দুর্ঘটনাকে (গার্ডার পড়া) ঘিরে কিছুটা সময় নষ্ট হবে।
দুর্ঘটনার পর গঠিত স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তদন্ত কমিটির সদস্যরা একাধিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন বলে জানা গেছে। সেখানে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেন। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কমিটির প্রধান ও এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রত্যক্ষদর্শী যাঁদের পাওয়া গেছে, তাঁদের নিয়ে এলজিইডি কার্যালয়েও বসেছি। সবার সঙ্গে কথা বলে তদন্তের আরও কিছু কাজ শেষে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’
গার্ডারটি অরক্ষিত অবস্থায়
দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ওপর থেকে পড়ে যাওয়া গার্ডারটি নিচে আরেকটি গার্ডারের ওপর পড়ে আছে। স্থানটি চিহ্নিত করে সেখানে কোনো ঘেরাও দেওয়া হয়নি। দুপাশে বেরিয়ে আছে মোটা রডের গুচ্ছ। পথচারীদের গায়ে লাগলেও কিছু করার নেই। সেখানে একটি স্তম্ভে (পিয়ার) লোহার মই বাঁধা। তিনজন পথশিশুকে দেখা গেল খেলা করছে।
একজন ফলওয়ালা বললেন, অনেক সময় রাতেও তিনি ফল বিক্রি করেন। দুর্ঘটনার রাতে আগে আগে ঘরে ফিরে গেছেন। আবদুর রহমান নামের একজন রিকশাচালক বলেন, দুর্ঘটনার আধা ঘণ্টা আগে তিনি এই পথ দিয়ে যাত্রী নিয়ে রামপুরা গেছেন। তাঁদের মতে, দিনের বেলায় এই দুর্ঘটনা ঘটলে অনেক মানুষ মারা যেত।
অব্যবস্থাপনা, দুর্ভোগ
রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মোড় থেকে একটু পশ্চিমে উড়ালসড়কের প্রবেশপথ (লুপ)। সেখানে অগোছালোভাবে ছড়িয়ে আছে ব্লক, স্ল্যাব, বাঁকানো রড। কিছু কিছু রাস্তায়ও ছড়ানো। পাশেই শুরু হয়েছে রাস্তার দুরবস্থা। কোনো কোনো অংশ খানাখন্দে ভরা। পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে রাস্তাটি যেন রাস্তা নয়, পুকুর। যানবাহন চলছে, কিন্তু চালক জানেন না, পানির নিচে কী আছে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের এক ছাত্রীকে নিয়ে গুলবাগ ফিরছিলেন বাবা রফিকুল ইসলাম। তিনি রিকশাচালককে সাবধানে চালাতে বলছিলেন। রিকশাচালক বললেন, ‘কত বছর আর সাবধানে চালামু, পুকুরের নিচে কী আছে ক্যামনে জানুম?’
রফিকুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘এভাবেই দুর্ভোগ চলছে বছরের পর বছর। কবে রেহাই পাওয়া যাবে বলতে পারেন?’
মৌচাক মোড় থেকে রামপুরার দিকের রাস্তা বিভাজকের পশ্চিম পাশে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ। সেখানে ওয়াসার ড্রেনেজ লাইনের পাইপ বসানো হচ্ছে। পুরো রাস্তা কাদা আর আবর্জনায় ভরা। বিভাজকের অপর পাশের অংশকে কোনোমতে দ্বিমুখী চলাচলের আওতায় আনা হয়েছে। সেখানে যানবাহন চলছে আর ধুলা উড়ছে। তরঙ্গ পরিবহনের একটি বাস নূর স্যানিটেশন নামের দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একটি রিকশায় লাগলে যাত্রী পড়ে যেতে যেতে বেঁচে যান। যাত্রী নেমে চিৎকার দিলে বাসচালক বলেন, ‘ধুলায় কিচ্ছু দেখা যায় না। কী করন যায়।’
রাস্তার ধারের বেশির ভাগ দোকানের সামনের দরজা আংশিক খোলা। সেলফোনের সিমকার্ড বিক্রেতা সুমন জানান, অনেক দোকানে ব্যবসাই বন্ধ হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে যানবাহন চলতে গিয়ে দোকানে পানি ছিটে আসে। অন্য সময় দোকান ভরে যায় ধুলায়।
এক রাস্তায় দ্বিমুখী চলাচলের ব্যবস্থা করায় সারাক্ষণ ভয়ানক যানজট লেগে থাকে বলে জানান দোকানিরা। রিকশায় চেপে সিদ্ধেশ্বরীতে একটি কোচিং সেন্টারে ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছিলেন হাজীপাড়ার বাসিন্দা তাহমিনা বেগম। দুটি বাস আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নামলে সরু রাস্তায় রিকশা আটকে পড়ে। ছেলে ফাহিম মাকে বলে, ‘মা, আজও স্যারের বকা খেতে হবে।’ উন্নয়নের এই দুর্ভোগ থেকে এখন রেহাই পেতে চান তাঁরা।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1111540/