১৮ মার্চ ২০১৭, শনিবার, ১০:০৯

অফশোর ব্যাংকিংয়ে ঋণ বেড়ে ৩৯ হাজার কোটি টাকা

বঞ্চিত হচ্ছেন আমানতকারীরা; মুনাফা যাচ্ছে দেশের বাইরে

বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে ব্যাংকে জমছে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল। উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে প্রায় এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। টাকার চাহিদা না থাকায় কমছে ব্যাংক ঋণের সুদ। তুলনামূলক সস্তায় মিলছে ব্যাংক ঋণ। কিন্তু এর পরেও কম সুদের সুযোগে অফশোর ব্যাংকিংয়ের (ওবিইউ) নামে দেদার আসছে বিদেশী ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ডিসেম্বর শেষে ওবিইউ’র মাধ্যমে বিদেশী ঋণ এসেছে ৩৯ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৫৮ শতাংশই এসেছে ৩৯টি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে। আর ৪২ শতাংশ এসেছে ৯টি বিদেশী ব্যাংকের মাধ্যমে। বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ বেড়ে যাওয়ায় এর বিপরীতে নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে বৈদেশিক মুদ্রায় সুদ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। আর এ কারণে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের আমানতকারীসহ সাধারণ গ্রাহক। টাকার চাহিদা না থাকায় আমানতের সুদহার কমে তলানিতে চলে আসছে। এখন ব্যাংকে ১০০ টাকা আমানত রেখে সরকারের কর পরিশোধ করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন টাকার ওপরে মুনাফা পাচ্ছেন না আমানতকারীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ডিসেম্বর শেষে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিদেশী ব্যাংকের মাধ্যমে। এর মধ্যে বেসরকারি ৩৯টি ব্যাংকের মাধ্যমে এ ঋণ এসেছে ২২ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। আর বিদেশী ৯টি ঋণ ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১৬ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। পাঁচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মধ্যে শুধু অগ্রণী ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিংয়ে ঋণ রয়েছে ১০৯ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইতোমধ্যে দুই ব্যাংক ঋণখেলাপি হয়েছে। ব্যাংক দু’টির মধ্যে প্রাইম ব্যাংকের ৯৫ কোটি টাকা এবং স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার অফশোর ব্যাংকিংয়ে ঋণখেলাপি হয়েছে ছয় কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এ দুই ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিংয়ে মোট খেলাপি ঋণ রয়েছে ১১০ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
অফশোর ব্যাংকিংয়ে ঋণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এতে দুই ধরনের সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে দেশ। প্রথমত, বর্তমানে বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধ করতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু বিনিয়োগ চাহিদা বাড়লে তখন বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার বেড়ে যাবে। আর আজকে যে বিদেশী ঋণ নেয়া হচ্ছে তা-ও একসময় সুদে আসলে পরিশোধ করতে হবে। এক দিকে বিনিয়োগ চাহিদা বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বাড়বে, পাশাপাশি বিদেশী ঋণের সুদসহ আসল পরিশোধ করতে চাপে পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। তখন আজকে যে ডলার পাওয়া যাচ্ছে ৮০ টাকায়, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ওই ডলার কিনতে অতিরিক্ত চার টাকাও ব্যয় করতে হলে বিদেশী ঋণের প্রকৃত সুদও বেড়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, দেশে বর্তমান পর্যাপ্ত বিনিয়োগযোগ্য তহবিল রয়েছে। টাকার চাহিদা না থাকায় ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কমিয়ে দিচ্ছে। বছর তিনেক আগেও ১০০ টাকা আমানত নিতে ব্যাংকগুলো ব্যয় করছে সর্বোচ্চ ১৪ টাকা পর্যন্ত। এখন বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে তা পাঁচ টাকায় নেমে এসেছে। মুনাফার ওপর কর শনাক্তকারী নম্বর বা টিআইএন না থাকলে ১৫ শতাংশ এবং টিআইএন থাকলে ১০ শতাংশ হারে কর পরিশোধ করতে হচ্ছে আমানতকারীদের। এ কারণে ১০০ টাকা ব্যাংকে আমানত রেখে ট্যাক্স পরিশোধ করে সর্বোচ্চ পাওয়া যাচ্ছে পাঁচ টাকার নিচে। যেখানে মূল্যস্ফীতি রয়েছে সাড়ে ছয় ভাগ। প্রকৃতপক্ষে ১০০ টাকা আমানত রেখে একজন আমানতকারী লোকসান দিয়ে মূলধন সাড়ে ৯৮ টাকায় নেমে যাচ্ছে। এ কারণে আমানতকারী ব্যাংক বিমুখ হয়ে পড়ছে। এতে সার্বিকভাবে কমে যাচ্ছে আমানত। ভবিষ্যতে দেশে বিনিয়োগ চাহিদা ফিরে এলে তখন বিনিয়োগ করার মতো তহবিল হাতে থাকবে না ব্যাংকের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় ব্যাংকগুলো এখন অফশোর ব্যাংকিংয়ের নামে দেদার আনছে বিদেশী তহবিল। আগে মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ কয়েকটি খাতে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তহবিল জোগান দেয়ার সুযোগ ছিল। এখন সার, আলুবীজসহ আরো কয়েকটি খাতে এ তহবিল আনার সুযোগ দেয়া হয়। সুদ কম হওয়ায় বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই অফশোর ব্যাংকিংয়ে তহবিল সরবরাহের চাহিদা দিচ্ছেন। আর কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা না থাকায় ব্যাংকগুলোও দেদার অফশোর ব্যাংকিংয়ের নামে বিদেশী ঋণ নিচ্ছে।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে গ্রাহকের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মেটাচ্ছে। যেমন, কোনো গ্রাহক ৫০ কোটি ডলারের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করল। স্থানীয় ব্যাংক বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ৪ শতাংশ সুদে আমানত নিয়ে বিদেশী রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করল। শর্ত অনুযায়ী ছয মাস পর আমদানিকারক সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে পরিশোধ করছে। এটাই অফশোর ব্যাংকিং। এভাবে ঋণ নেয়া বা দেয়ার সুনির্দিষ্ট সীমারেখা দেয়া নেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। এ সুযোগে কিছু কিছু ব্যাংক দেদার আনছে বিদেশী ঋণ। আর নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে সুদে আসলে বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করা হচ্ছে। তিন মাস থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে এ ধরনের ঋণ নেয়া হচ্ছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বৈদেশিক ঋণের হ্রাস এখনই টেনে ধরতে হবে। অফশোর ব্যাংকিংয়ের নামে বৈদেশিক তহবিল আনার নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দিতে হবে। অন্যথায় বৈদেশিক দায় আরো বাড়লে চাপ বেড়ে যাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। কেননা, প্রতি মাসেই আড়াই শ’ কোটি ডলার থেকে তিন শ’ কোটি ডলার পরিশোধ করতে আয় আমদানির দায় মেটাতে। এর সমপরিমাণ বৈদেশিক ঋণের দায় মেটাতে হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রবল চাপের মুখে পড়ে যাবে, যা একসময় এর চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে। চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে দেশ।

www.dailynayadiganta.com/detail/news/204491