১৮ মার্চ ২০১৭, শনিবার, ৯:৪৭

প্রতিরক্ষা চুক্তি ও লোকরঞ্জনবাদ 

 

|| ড. আবদুল লতিফ মাসুম ||


আন্তর্জাতিক কৌশলগত রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ দেশটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘সেতুবন্ধ’। বঙ্গোপসাগরময় বাংলাদেশ। সেই পুরনো ‘বেঙ্গল’-এর বৃহৎ অংশ যেহেতু এ দেশের, সুতরাং পুরো বঙ্গোপসাগরটাই আমাদের। এই অবস্থান বাংলাদেশকে সামরিক, সামুদ্রিক ও বাণিজ্যিক দিক দিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রেখেছে। বাংলাদেশের ‘ভূ-রাজনীতির’ এসব সুবিধাজনক অবস্থা থাকা সত্ত্বেও এটি একটি অপ্রিয় বাস্তবতা যে, দেশটি এ রকম চারদিকে ভারত বেষ্টিত। বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত পৃথিবীর অন্যতম ‘ভঙ্গুর ও স্পর্শকাতর’ সীমান্ত। দক্ষিণে সমুদ্রের সুবিধা না থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করাই কঠিন ছিল। যে সমুদ্রের জন্য স্বাধীনতার নিশ্চয়তার কথা বলছি তাও ভারতীয় নৌবাহিনীর এক রকম একাধিপত্যের শিকার। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের যে দ্বন্দ্ব প্রকাশিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশের কদর বেড়েছে। একদিকে বাংলাদেশকে নিরঙ্কুশভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় ভারত। অন্য দিকে চীনের প্রয়াস বাংলাদেশকে নিজের নিগড়ে বাধা। ‘শত্রুর শত্রু মিত্র’ কৌটিল্যের এ কূটনীতি অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের সামরিক সহযোগিতা বেড়ে চলেছে। একই কারণে ‘পাক-চীন দোস্তি’ সবারই জানা কথা। এ ক্ষেত্রে একটি নতুন মোড়- সনাতন রুশ ভারত সম্পর্ক এড়িয়ে রুশ-পাক নতুন সখ্য। ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপের মালিকাধীন ‘ফাস্ট পোস্ট’ এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে চীনের প্রভাব থেকে মুক্ত করাই শেখ হাসিনার সমাগত ভারত সফরের মূল বিষয়। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির এই সমীকরণে ভারতের প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা চুক্তি আলোচনার অপেক্ষা রাখে।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির দিকনিদের্শনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশ হবে ‘প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড’। তিনি দেশকে যথার্থভাবেই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করেছিলেন। প্রতিবেশীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ১৯৭৪ সালে লাহোর ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কূটনীতির ক্ষেত্রের সম্ভবত সবচেয়ে বড় অবদান- বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার। আজকাল ভারতীয় এলিটদের স্মৃতিচারণে এসব কথা প্রকাশ পাচ্ছে যে ভারত বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে কিভাবে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি অব্যাহত রাখতে চেয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনে যেভাবে পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন ঘটে তা ছিল ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির যথার্থ ব্যর্থতা। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ভারতের জন্য পূর্ব সমীকরণে ফিরে যাওয়ার সুযোগ আসে। এ সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংযম ও সতর্কতার সাথে পররাষ্ট্রনীতির পরিচালনা করেন। ভারতের পক্ষে সে সময়ে ‘ট্রানজিট’ এবং প্রতিরক্ষা চুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মিত্র সরকারের সম্মতি নেয়া সম্ভব হয়নি। ২০০৭-৮ সালে বাংলাদেশে মার্কিন-ভারত যৌথ রণ কৌশলে সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকার কায়েম হলে ভারতের সাথে ‘সম্পর্কের ঐকতান’ সৃষ্টি হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে ভারতের সাথে সম্পর্কের নতুন মাত্রা অর্জিত হয়। ২০১৪ সালে জনগণকে বাদ দিয়ে একটি ‘কাগুজে নির্বাচন’ অনুষ্ঠিত হলে ভারতের সাথে সম্পর্ক নির্ণয়ে জনগণের সম্পৃক্ততার প্রশ্নটি পরিত্যক্ত হয়। ওই নির্বাচনের প্রাক্কালে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুষমা স্বরাজের ভূমিকার কথা নাগরিক সাধারণের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এ নির্বাচনের ফলে ভারতের সাথে ‘পেট্টন কায়েন্ট রিলেশন’ বা পোষ্য-পোষক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। ভারতে ‘গণতান্ত্রিক কংগ্রেস সরকার’ এর পরিবর্তে ‘হিন্দু প্রভাবিত বিজেপি সরকার’ প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত কংগ্রেস মিত্র সরকারের জন্য বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আরো নমনীয় হতে হয়। কোনো কোনো আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ এ অবস্থাকে ‘অধীনতামূলক মিত্রতা’ বলে অভিহিত করেন। এখন বিজেপি শাসিত ভারত একটি অসম প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ দিচ্ছে বলে খবর বেরিয়েছে। আর বাংলাদেশ সরকার তা নীতিগতভাবে অনুমোদন করছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে এটি বড় ধরনের বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিচ্যুতি। এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ‘বাংলাদেশ পুরোপুরিভাবেই ভারতের কব্জায় চলে যাবে।’ (বদরুদ্দীন উমর, ১৪ মার্চ ১৭, দৈনিক যুগান্তর)।
চুক্তি বনাম সমঝোতা : এই চুক্তির শিরোনাম নিয়ে কিছুটা শিরোপীড়ার কারণ ঘটেছে। ভারত চায় পরিপূর্ণভাবে শক্তপোক্ত একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি। চুক্তির বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট আগেই বণর্না করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের যে অংশ অবশিষ্ট আছে তাও ভারত কেড়ে নিতে চায়। যেকোনো দেশের জন্য এ ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তি অবমাননাকর। সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন তোলা যায় যে, এই চুক্তি কার জন্য বা কিসের বিপক্ষে? বাংলাদেশের চারদিকে যখন ভারত রয়েছে এবং ভারতের প্রভাব বলয়ের মধ্যে ক্ষমতাসীন সরকার রয়েছে তখন এ ধরনের চুক্তি যৌক্তিকতা একেবারই অবান্তর। স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এখানে চীনা ভীতিই মূল কারণ। ভারত বাংলাদেশের সরকারের দৃশ্যমান মিত্রতায় বিশ্বাস করতে পারছে না। তারা বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখতে চায়। এ দেশের যেকোনো দলীয় সরকার ক্ষমতার জন্য যেকোনো কিছু করতে পারে। আওয়ামী লীগ সরকার চুক্তি স্বাক্ষরে নীতিগতভাবে রাজি হয়েছে। তাদের মতপার্থক্য শুধু চুক্তির শিরোনাম নিয়ে। এ শিরোনাম বহির্বিশ্ব এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ভুল সংবাদ দেবে। আওয়ামী লীগের লোকজন এখন আর জনগণকে তোয়াক্কা করছে না। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাদের ‘ব্যালটের পরিবর্তে বুলেট’ নির্ভরতা সৃষ্টি হয়েছে। সেখানেই ভয়। কৌশলগতভাবে বাংলাদেশ সরকার তাদের সাময়িক চুক্তি করে খুশি করতে চায়। কিন্তু তারা চায় দীর্ঘস্থায়ী চুক্তি। স্মরণ করা যেতে পারে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং মিসেস ইন্ধিরা গান্ধীর মধ্যে ১৯৭৪ সালে ২৫ বছর মেয়াদি ‘শান্তি ও মৈত্রী’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারত ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে অনুরূপ চুক্তি স্বাক্ষর করে। সোভিয়েত সংস্কৃতি অনুযায়ী কৌশলে প্রতিরক্ষা চুক্তিকে অনুরূপ নাম দেয়া হয়। উল্লেখ্য, পূর্ব ইউরোপসহ পৃথিবীর অনেক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাথে তারা দৃশ্যমান শান্তি ও মৈত্রী চুক্তির নামে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে। মুজিব-ইন্ধিরা চুক্তির মধ্যে দিয়ে ‘বাংলাদেশ-ভারত- সোভিয়েত’ অক্ষশক্তির সৃষ্টি হয়। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে এ চুক্তির কার্যকারিতা স্থগিত হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের সাথে অনুরূপ গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল বলে অসমর্থিত তথ্য রয়েছে। যা হোক প্রস্তাবিত চুক্তি দ্বারা সরকার ‘দেশীয় রাজনীতিতে এমন কোনো ধারণার সৃষ্টি করতে চায় না যে দেশটি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারতের ওপর নির্ভর হতে যাচ্ছে।’ (সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়, ৭ মার্চ ২০১৭, প্রথম আলো) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতের সদ্য পদত্যাগকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর বাংলাদেশ সফরের সময় এই সুসংহত চুক্তির প্রস্তাব করেছিলেন। পরবর্তীতে পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্করের সফরের সময় বিষয়টিকে সমঝোতা স্মারকের পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের একটি কূটনৈতিক সূত্র থেকে ভারতকে এই বার্তা দেয়া হয় যে, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে জাতীয় স্বার্থে তারা সহযোগিতার ক্ষেত্র নির্ণয় করবে। চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশ ‘সিকিম-ভুটান’ হয়ে যেতে পারে বলে যে গণ আশঙ্কা রয়েছে তার দায় সম্ভবত ক্ষমতাসীন সরকার নিতে চায় না।
চুক্তির বিস্তৃতি : চুক্তি স্বাক্ষরের পটভূমি হিসেবে সমরবিশারদরা ক. চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিং পিং-এর বাংলাদেশ সফরের কার্যকারিতা, খ. চীন থেকে বাংলাদেশের দুটো সাবমেরিন ক্রয়, গ. ভারতের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমেই সম্প্রসারিত সামরিক শক্তি, ঘ. বাংলাদেশকে চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতাহীন করার পরিকল্পনা ও ঙ. বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হলে সে ক্ষেত্রে যেন বাধ্যবাধকতা থাকেÑ এ ধরনের কারণগুলোকে দায়ী করছেন। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পরে যখন ভারতে এই প্রথমবারের মতো হিন্দু মৌলবাদী শক্তি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, তখন এ ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর দেশপ্রেমিক নাগরিক সাধারণকে বিচলিত না করে পারে না। যেখানে ভারত নিজেই একটি অর্থসঙ্কটে নিপতিত দেশ তারা কি স্বার্থে বাংলাদেশকে ৫০ কোটি ডলার প্রতিরক্ষা ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। এ চুক্তি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশে যৌথ সহযোগিতায় প্রতিরক্ষা সরাঞ্জাম তৈরি হবে। এ ছাড়া সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ আরো নিবিড় করা হবে। বিভিন্ন সামরিক প্রশিক্ষণ শিবির আরো বাড়ানো হবে। বাংলাদেশের জন্য সামরিক নৌযান নির্মাণেও ভারত সাহায্য করবে। দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে বেশ কয়েক বছর ধরেই যৌথ মহড়া অনুষ্ঠিত হচ্ছেÑ এর পরিধি আরো বাড়ানো হবে। সর্বতোভাবে বাংলাদেশকে বিশেষত এর সেনাবাহিনীকে প্রকারান্তরে নিয়ন্ত্রণে নেয়াই ভারত সরকারের উদ্দেশ্য। বিগত দীর্ঘ বছরগুলোতে ভারতের তরফ থেকে এ ধরনের চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তাব কখনোই আসেনি।
লোকরঞ্জনের বিষয়াদি : বাংলাদেশের জনগণ কারণে বা অকারণে ভারতবিরোধী। ক্ষমতাসীন সরকারের কারণে অনেকে মুখ না খুললেও সরকার যে তা অনুধাবন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতা-বিবৃতিতে তা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ১. প্রধানমন্ত্রী ১১ মার্চ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে এক অনুষ্ঠানে অভিযোগ করেন যে, ‘বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং আমেরিকা জোট বেঁধে ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারিয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে আমেরিকান কোম্পানি আমাদের গ্যাস বিক্রি করতে চাইল ভারতের কাছে। ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রির মোচলেকা দিয়েছিল খালেদা জিয়া। দিয়েতো সে ক্ষমতায় এসেছিল। আমি তা দেইনি। আমি চেয়েছিলাম আগে আমাদের দেশের মানুষের কাজে লাগবে, ৫০ বছরের রিজার্ভ থাকবে। তারপর আমরা ভেবে দেখব বিক্রি করব কি করব না।’ (১২ মার্চ ২০১৭, দৈনিক যুগান্তর) এ বক্তব্যের পর যে কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন যে বাংলাদেশের ক্ষমতার পালাবদল কী এ রকম হস্তক্ষেপের কারণেই হয়েছিল? ১৯৯৬, ২০০৯ ও ২০১৪ সালে ক্ষমতার যে রদবদল হয়েছে সেটা কি এ রকম বিদেশী প্রভুর ইঙ্গিতে ঘটেছিল? মূলত প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের বাস্তবতা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে চেয়েছেন। চুক্তি সম্পর্কে এতে তার মৃদু বিরোধিতার আভাস পাওয়া যায়। মানুষকে আস্থায় রাখার জন্য তিনি হয়তো লোকরঞ্জনের পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। তবে একইসাথে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দায়ী করে তিনি সমস্যায় পড়তে পারেন। ২. ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারতকে তুষ্ট করার জন্য বর্তমান সরকার কি না করেছে? ২ ক. বাংলাদেশের সমুদ্র ও নৌবন্দর ব্যবহারের সুবিধা তারা ভারতকে দিয়েছেন উদারভাবে। ২ খ. ভারতকে শেষ পযর্ন্ত তারা করিডোরও দিয়েছেন। ২ গ. বাংলাদেশের জনগণের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও তারা রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য ভারতের সাথে চুক্তি করেছেন। ২ ঘ. বাংলাদেশের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এখন ভারতীয় হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠছে। অথচ বাংলাদেশের মানুষ ভারতের সাথে এই সময়ে দুটো বড় ধরনের সমস্যার মোকাবেলা করছে। প্রথমত, তিস্তার পানি। দ্বিতীয়ত, সীমান্তে নাগরিক হত্যা। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এ দু’টি বিষয়ে ক্ষুব্ধ রয়েছেন। তিনি তার উপরোক্ত মন্তব্যের দ্বারা ভারতকে বাধ্যবাধকতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছেন। ৩. প্রকাশিত খবরে জানা যায় যে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়েছিল। সফর কর্মসূচি কয়েকবার পরিবর্তিত হয়েছে। এ রকম হতে পারে যে, প্রধানমন্ত্রী যতক্ষণ পর্যন্ত জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কে নিশ্চিত না হচ্ছেন ততদিন পর্যন্ত তিনি সম্মতি দেননি। এটি ভারতকে এবং একই সাথে জনগণকে তার মনোভাব জ্ঞাপনের কৌশল হতে পারে। ৪. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের প্রদত্ত দু’টি সাবমেরিনের আনুষ্ঠানিক কমিশনিং উপলক্ষে বলেন, ‘আমরা কারো সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাই না। তবে কেউ যদি আমাদের ওপর আক্রমণ করে, আমরা যেন তার সমুচিত জবাব দিতে পারি সেজন্যই সব প্রস্তুতি থাকবে।’ প্রধানমন্ত্রীর এ উক্তি জনগণকে আশ্বস্ত করবে। সামরিক বাহিনীকে সাহস দেবে। সেই সাথে এই প্রশ্নও করা যায় যে, চারদিকে যখন সব মিত্র তখন এই সাহসী উচ্চারণ কার বিরুদ্ধে? ৫. ক্ষমতাসীন সরকারের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ১৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা যা করবেন, তা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থেই করবেন। দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো চুক্তি তিনি করবেন না। তিস্তা চুক্তি শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কেউ করতে পারবেন না।’ ৬. আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দৈনিক ইত্তেফাকের সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে নিশ্চিত করেন যে, ‘জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে কিছুই করা হবে না।’ তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার অতীতে ভারতের সাথে কোনো গোপন চুক্তি করেনি ভবিষ্যতেও করবে না।’ ৭. বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপির পক্ষ থেকে প্রদত্ত বিবৃতিতে প্রস্তাবিত চুক্তিকে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ববিরোধী বলে অভিহিত করা হয়। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী রয়েছে। তা সত্ত্বেও সরকার প্রতিরক্ষার বিষয়টি ভারতের হাতে তুলে দিচ্ছে। এভাবে বাংলাদেশ ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত হবে।’
ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্ভাব্য প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যা বলেছেন তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় ‘পপুলিজম’। পপুলিজম শব্দটি বাংলায় লোকবাদ, জনপ্রিয় কর্মপদ্ধতি এবং জনরঞ্জন বা লোকরঞ্জনবাদ বলে পরিচিতি পেয়েছে। আর সব টার্মের মতো এটিও পাশ্চাত্য থেকে ধার করা। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে পপুলিজম শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায় যে, ‘সাপোর্ট ফর দ্য প্রেফারেন্সসেস অব অডিনারি পিপল’। পপুলিশ শব্দটি রুশ ‘নারদনিক’ শব্দের প্রতি শব্দ। সাধারণ মানুষকে তুষ্ট করার জন্য যেসব কথা ও কাজ করা হয় তা সবই লোকরঞ্জনবাদ। শব্দটির ইতিবাচক দিক হচ্ছে- সহজ সরলভাবে সাধারণ মানুষের উপকারের জন্য কিছু করা। আর নেতিবাচক অর্থটি হচ্ছেÑ অতিভাষণ, অনার্থক ভাষণ অথবা লোক খুশি করার ভাষণ ও কাজ। ভারতের সাথে কথিত প্রতিরক্ষা চুক্তির ও ইতিবাচক ও নেতিবাচক লোকরঞ্জন বক্তব্য আছে। চুক্তিটি স্বাক্ষরের পর বোঝা যাবে আমাদের রাজনীতিকেরা জনগণকে সত্য বলেন নাকি অসত্য বলেন।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com

www.dailynayadiganta.com/detail/news/204395