১ এপ্রিল ২০২০, বুধবার, ৯:৪৮

বিচলিত হওয়ার কিছু নেই

চীনা সভ্যতা বহু প্রাচীন, যাকে আমরা শ্রদ্ধা করি। সেই চীন থেকেই বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে, যাতে ইতোমধ্যে লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত ও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। করোনাভাইরাস মানুষের দেহে উৎপন্ন করে ভয়াবহ ফুসফুসের ব্যাধি। সৃষ্টি হয় ফুসফুসের এক বিশেষ ধরনের নিউমোনিয়া।

শ্বাস-প্রশ্বাসের বাতাসের সঙ্গেও নাকি ছড়াতে পারে। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ সময় অধ্যাপনা করেছি। দীর্ঘদিন ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করতে হয়েছে। আমার ডিএসসি থিসিস ছিল ভাইরাস সংক্রান্ত। আমার সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলব, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি অতটা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেনি, যতটা বলা হচ্ছে। এ নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।

যাহোক, রোগ কারো মিত্র নয়। করোনার জন্য মানুষ বাইরে কাজ করতে পারছে না। ফলে সব কিছুরই উৎপাদন হ্রাস পাবে। যেমন আমাদের দেশে এখন কৃষকরা চৈতালি ফসল তুলতে যাচ্ছে। অর্থনীতির দুটো দিক আছে। সরবরাহ ও চাহিদা। সরবরাহ কমে গেলে জিনিসের দাম বাড়ে। করোনার কারণে উৎপাদিত পণ্যর সরবরাহ কমে যাবে। সুতরাং দ্রব্যমূল্য বাড়বে। এর মধ্যে যদি মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানো হয়, তবে দ্রব্যমূল্য আরও দ্রুত বৃদ্ধি না পেয়েই পারে না। এসব সাধারণ কথা বলতে হচ্ছে, কারণ কেউ কেউ বলছেন, কাগুজে মুদ্রা বানিয়ে বর্তমানে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তার একটা সমাধান করা যাবে। কিন্তু যেহেতু দ্রব্য সরবরাহ কমছে, তাই মুদ্রা সরবরাহের সাধারণ অর্থ দাঁড়াবে চাহিদা বাড়ানো, যার ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হবে।

অনেকে এই অবস্থা কাটিয়ে নেবার জন্যে বলছেন বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে। এক্ষেত্রে আমাদের সাধারণ ধারণা খাপ খাচ্ছে না। মুদ্রা সরবরাহ মানে অর্থনীতিতে সংকট আরও কঠিন হয়ে উঠবে। ব্রিটিশ শাসন আমলে একবার প্রাকৃতিক কারণে ধানের উৎপাদন কম হওয়ায় চালের সরবরাহ কমে। অন্যদিকে সেসময় চলছিল গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে জাপানের যুদ্ধ। যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করার জন্য ছাপানো হয়েছিল টাকা। ফলে ১৩৫০ সালে সৃষ্টি হতে পেরেছিল এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। করোনার কারণে নিশ্চিতভাবেই ধানের উৎপাদন কমবে। আর এর ফলে ঘটবে অন্নাভাব। করোনার কারণে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। হারাচ্ছে তাদের সাধারণ কর্মশক্তি। পত্র-পত্রিকায় করোনার প্রভাবে কত ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতে যাচ্ছে তার সম্ভাব্যতার কথা বলা হচ্ছে। সেটা একটা বিরাট অংক। আমাদের দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ. মনসুর বলছেন, চীনের করোনা ভাইরাসজনিত সমস্যা দীর্ঘমেয়াদী হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভয়ানক বিপর্যয় বাড়বে। তাঁর মতে, বাংলাদেশ সরকারের মেগা উন্নয়ন প্রকল্পসমূহে চীনের বিকল্প নেই। আবার চীন থেকে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এসব পণ্যের দাম বাড়বে, যাতে সরকারের রাজস্ব আয়ে বড় প্রভাব পড়বে। ঘাটতি বাড়বে। সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে দেশের প্রধান রপ্তানিখাত তৈরি পোশাক শিল্পে। কারণ, এই খাতের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির প্রধান উৎস চীন। আর চীনের মতো এত সস্তায় আমাদের কেউ এত পণ্য সরবরাহ করতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, প্রয়োজন হলে দেশীয় কৃষকদের প্রণোদনা দিয়ে আদা ও রসুন চাষাবাদের উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের কাছে প্রশ্ন হলো, চীনের নিজের অর্থনীতিও করোনার কারণে বিপর্যস্ত হয়েছে। চীন কি আমাদের আগের মতো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারবে? ইতোমধ্যেই চীনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪২০ বিলিয়ন ডলারের উপর।

একজন গ্রামীণ কৃষক আমাকে এসে বললেন, আমরা হাত-পা নেড়ে খাই। এভাবে গৃহবন্দি হয়ে থাকলে আমরা মরব অনাহারে। করোনার পাশাপাশি আরেকটা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। একটা পাট-খাটা লোক (যে দিন আনে দিন খায়) সে দিনের পর দিন ঘরে বসে থাকলে কী করে খাবে? তার তো কোনো আয় নেই। কৃষক মাঠে কাজ করতে পারছে না। করোনাসৃষ্ট এসব সংকট মোকাবিলায় যথোপোযুক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। আর বিশ্বাস রাখতে হবে, দুঃসময় স্থায়ী নয়, সুসময় আসবেই।
লেখক: উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও কলাম লেখক

https://www.dailyinqilab.com/article/279785/