১৫ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১২:০১

পুরনো কায়দায় হামলা খুনে নতুন আতঙ্ক

আবারো শুরু হয়েছে সেই পুরনো কায়দায় হামলা ও খুন। এবারো টার্গেট পীর ও ধর্মীয় নেতা। পরপর এ ধরনের দু’টি ঘটনায় নতুন করে আতঙ্ক শুরু হয়েছে। এসব ঘটনার পর ইতোমধ্যে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সতর্ক করা হয়েছে।
দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ থানার ৪ নম্বর আটগাঁ ইউনিয়নের দৌলা গ্রামে কাদেরিয়া মোহাম্মদিয়া খানকাহ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা ফরহাদ হোসেন চৌধুরী এবং তার গৃহপরিচারিকা রূপালী বেগমকে গত সোমবার রাতে দুর্র্র্বৃত্তরা গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে। ফরহাদ হোসেন চৌধুরী ওই খানকাহ শরিফের মোতাওয়াল্লি ছিলেন। স্থানীয়রা তাকে পীর হিসেবে জানতেন। তিনি দিনাজপুর পৌর বিএনপির সভাপতি ছিলেন। দিনাজপুর বাস মালিক সমিতিরও সভাপতি ছিলেন তিনি। কে বা কারা তাকে হত্যা করেছে সে সম্পর্কে এখনো পুলিশ ও গোয়েন্দারা নিশ্চিত নন। তবে গতকাল মঙ্গলবার এ ঘটনায় খানকাহ শরিফের এক খাদেমকে আটক করেছে পুলিশ। ঘটনার ব্যাপারে বোচাগঞ্জ থানায় মামলা হয়েছে। তবে থানার ওসি গত রাতে বলেছেন, প্রাথমিকভাবে তাদের ধারণা খানকাহ শরিফ নিয়ে বিবাদের কারণে এই খুনের ঘটনা ঘটতে পারে। এর বাইরে এখনো কোনো চিন্তা করছেন না তারা। অন্য দিকে পাবনার চাটমোহর উপজেলার মথুরাপুর ক্যাথলিক চার্চের নৈশপ্রহরী গিলবার্ট কস্তাকে (৬৫) গত বৃহস্পতিবার কুপিয়ে আহত করা হয়েছে।
পরপর এ দু’টি ঘটনায় ধর্মীয় নেতা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও পীরসহ অনেকের মধ্যেই নতুন করে আতঙ্ক শুরু হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত বেশ কিছু পীর-মুরিদ, ধর্মীয় নেতা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও বিদেশী নাগরিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। গত বছরের ১৪ মে রাতে বান্দরবানের বাইশারীতে গলা কেটে হত্যা করা হয় বৌদ্ধভিক্ষু মংশৈ উ চাককে। ৬ মে সন্ধ্যায় রাজশাহীর তানোর উপজেলায় মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ (৬০) নামে এক ‘পীর’কে গলা কেটে হত্যা করা হয়। ৩০ এপ্রিল টাঙ্গাইলের গোপালপুরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় দর্জিদোকানি নিখিল চন্দ্র জোয়ার্দারকে। ২৩ এপ্রিল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় পরমানন্দ রায় নামে এক সাধুকে একই কায়দায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট রাতে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের নিজ বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী। দুর্বৃত্তরা বাসায় ঢুকে তাকে গলা কেটে হত্যা করে। ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর গোপীবাগের ৬৪/৬ আর কে মিশন রোডের দ্বিতীয়তলায় লুৎফর রহমান ফারুক এবং তার ছেলে সরোয়ার ইসলাম ফারুক ওরফে মনিরসহ ছয়জনকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত লুৎফর রহমান নিজেকে ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি দাবি করে নতুন এক ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করে আসছিলেন। তার কিছু অনুসারী ছিল। কারা এই খুনে জড়িত, কেন এই খুনের ঘটনা ঘটেছে সব কিছুই এখনো অন্ধকারে।
২০১৩ সালের ৯ আগস্ট ঈদুল ফিতরের আগের দিন খুলনার খালিশপুরে তৈয়েবুর রহমান (৭০) ও তার ছেলে নাজমুম মনিরকে (১৩) গলা কেটে হত্যা করা হয়। ভক্ত হিসেবে ওই বাসায় প্রবেশ করে দুবর্ৃৃত্তরা বাবা-ছেলেকে গলা কেটে হত্যা করে। মুসলিম উম্মাহ নামে একটি সংগঠনের প্রধান ছিলেন তৈয়েবুর রহমান। ওই সংগঠনের সদস্যরা শনিবার জুমা ও প্রতিদিন তিন ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। রোজা রাখতেন ১০টি। নিজেকে উম্মুল মুমিনিন দাবি করতেন তৈয়েবুর।
২০১৪ সালে উত্তরায় খুন হন মাসুম। মাসুম একসময় উগ্রবাদী সংগঠনের সদস্য ছিলেন বলে জানা যায়। পরে তিনি ওই পথ ছেড়ে ফলের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডায় খুন হন পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খান। তিনিও পীর ছিলেন এবং নিজ বাড়িতেই একটি খানকাহ পরিচালনা করতেন।
২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানার বাংলাবাজার মাজারে ঢুকে ল্যাংটা ফকির ও তার মুরিদ আবদুল কাদেরকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই বছর ৫ অক্টোবর কর্ণফুলীর খোয়াজনগর এলাকা থেকে সুজন বাবু নামে এক যুবককে আটক করা হয়। গত বছরের ৭ মার্চ এই মামলায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার এসআই সন্তোষ কুমার চাকমা চার্জশিট দেন। তাতে উল্লেখ করা হয়, সুজন বাবু জেএমবির একজন সদস্য এবং সে-ই ল্যাংটা ফকির ও তার মুরিদকে হত্যা করেছে।
২০১৫ সালের ৩১ জুলাই ধানমন্ডি মসজিদের খাদেম দুলাল গাজীকে (৫০) এশার নামাজের সময় ইমামের ঘরে গলায় গামছা পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়। ওই বছরের নভেম্বরে বগুড়ায় শিয়া মসজিদে বোমা হামলায় পাঁচ জেএমবি সদস্য জড়িত বলে দাবি করে পুলিশ। গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে মন্দিরের পুরোহিত জগেশ্বরী দাসাধিকারী এবং ২৫ ডিসেম্বর বাগমারায় আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মসজিদে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনার কুশীলবরা এখনো অধরা। ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর ঈশ্বরদীতে ধর্মযাজক লুক সরকারকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় ছয় জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।
২০১৫ সালের ২৪ অক্টোবর রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডের হোসনী দালানে ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে দুইজন নিহত এবং অন্তত দেড় শ’ মানুষ আহত হন। ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যার পরে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার চককানু গ্রামে শিয়া সম্প্রদায়ের আল মোস্তফা নামে একটি মসজিদে সন্ত্রাসীদের গুলিতে মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেন (৭০) নিহত এবং ইমামসহ তিনজন গুরুতর আহত হন। ১১ ডিসেম্বর দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার জয়নন্দ ডহচি গ্রামে ইসকন মন্দিরে গুলি চালায় দুর্বৃত্তরা। এতে রঞ্জিতচন্দ্র রায় ও মিঠুনচন্দ্র রায় নামে দু’জন গুলিবিদ্ধ হন। এর আগে ৪ ডিসেম্বর রাতে কাহারোলের কান্তজীউ মন্দিরে রাস মেলায় বোমা হামলার ঘটনায় ৬ জন আহত হয়। ৩০ নভেম্বর রাতে চিরিরবন্দর উপজেলার রানীরবন্দরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে বীরেন্দ্রনাথ রায় নামে এক হোমিও চিকিৎসক আহত হন।
গত বছরের ২০ মে দুর্বৃত্তদের হামলায় কুষ্টিয়ার কবুরহাটের বটতৈল এলাকায় ছানোয়ার হোসেন (৫৫) নামে এক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক নিহত এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইফুজ্জামান গুরুতর আহত হন। ২০ মে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে জুতা ব্যবসায়ী দেবেশচন্দ্র প্রামাণিককে (৬৮) গলা কেটে হত্যা; এর কয়েক দিন আগে গোবিন্দগঞ্জে তরুণ দত্তকে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালের মে মাসের পর দিনাজপুর ও পাবনায় আবারো ঘটনা ঘটায় পুলিশ ও গোয়েন্দাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো থেকে। পুলিশ সদরের এক কর্মকর্তা জানান, ঘটনা দুটো নজরে রাখা হচ্ছে। এর পেছনে অন্য কোনো মতলব রয়েছে কি না তা দেখা হচ্ছে।

 

www.dailynayadiganta.com/detail/news/203730