৩১ মার্চ ২০২০, মঙ্গলবার, ১২:১৪

নীরব আর্তনাদ

স্বল্প-মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা কর্মসূচি দাবি

‘হাত ধুইলেই কি পেট ভরবো’ রাজধানীর কড়াইল বস্তির মিস্ত্রি মো. কামালের স্ত্রী শিউলি বেগমের এই উক্তি যেন দেশের কোটি কোটি কর্মহীন হতদরিদ্র মানুষের কণ্ঠস্বর। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষায় পেতে বার বার হাত ধোয়ার পরামর্শ দেয়ায় ক্ষুধার্ত শিউলি এই উক্তি করেন।

করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন দেশের শ্রমজীবী গরিব মানুষ। অঘোষিত লকডাউনে শিউলির পরিবারের মতোই দেশের ‘দিন আনে দিন খাওয়া’ লোকগুলো অসহায়। বিশ্বব্যাংকের হিসেব মতে রাজধানীর ৪০ লাখসহ বাংলাদেশে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ২৮ লাখ। এর মধ্যে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের অবস্থান দারিদ্র্য সীমার নিচে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি অপরিহার্য। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনে পাকিস্তান, ভারত ইতোমধ্যেই নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের খাওয়ার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছে। বাংলাদেশেও সে উদ্যোগের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও লালফিতার দৌড়াত্মে কার্যকরে বিলম্ব হচ্ছে। পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে রাজনীতিক রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘আমরা এমনিতেই দেরি করে ফেলেছি। এখন সংকট মোকাবেলা আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর করে সম্ভব নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিকে সম্পৃক্ত করতে হবে’।

‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভ‚তি কি মানুষ পেতে পারে না ও বন্ধু...’ (ভূপেন হাজারিকা)। করোনভাইরাসে লকডাউনে রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে বসে থাকা কর্মহীন ক্ষুধার্ত হতদরিদ্র অসহায় মুখের দৃশ্যগুলোর দিকে তাকালে কালজয়ী মানবতার এই গানটির কথা মনে পড়ে। পাকিস্তান, ভারত এমনকি পাশের পশ্চিমবঙ্গেও হতদরিদ্র মানুষের মুখ খাবার তুলে দিতে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি চালু করেছে। কানাডা সরকার তাদের নাগরিকদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ পৌঁছে দিয়েছে লকডাউন ঘোষণার পরপরই। আমেরিকা ৩৩ লাখ বেকারকে ভাতা দিচ্ছে। অন্যান্য দেশও হতদরিদ্র মানুষের সহায়তার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সরকারের পাশাপাশি ওই সব দেশের শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, সমাজসেবক, সমাজের বিত্তবান, শিল্পী-সাহিত্যিক-খেলোয়াড়সহ বিভিন্ন দেশার দানশীল মানুষ এগিয়ে এসে অর্থ সহায়তা করছেন। কিন্তু বাংলাদেশে প্রস্তুতি ও এ ধরনের সহায়তা ‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি’ প্রবাদের মতোই কিছু ব্যক্তি কিছু সহায়তার করলেও দ্বিগুণ অর্থ ব্যয় করে সেটাকে টিভিতে প্রচার করাচ্ছেন।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, মানুষ যদি মানবিক হতে না পারে তাহলে এই মহাদুর্যোগ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। মানুষের দায়টা বুঝতে হবে। সচেতনতার নামে অন্যের অধিকার হরণ করে আসলে ভালো থাকা যায় না। অতীতে দুর্যোগময় সময়ে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে দেখছি। আবার হিংসা, জুলুমও দেখছি। আমি মনে করি, সহিষ্ণু মনোভাব প্রকাশ করেই এই মহামারী মোকাবেলা করতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের হিসেব মতে অতিধনী বৃদ্ধির হারের দিকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। ধনী বৃদ্ধির হারে তৃতীয়। দ্রুত মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি বা ধনী হওয়ার যাত্রায় বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও অতিগরিব মানুষের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। অতিগরিব মানুষের সংখ্যা বেশি এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। অঘোষিত লক ডাউনে টিভিতে কিছু মানুষকে সহায়তা দিতে দেখা গেলেও রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলিতে দেখা গেল প্রচুর মানুষ কাজ ও খাদ্যের জন্য অপেক্ষা করছে। যাত্রাবাড়ীতে মো. হিরু নামের একজন জানালেন, তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। কাজ বন্ধ থাকায় তিনি খাবার ক্রয় করতে পারছেন না। ধারদেনা করে দুদিন চলার পর আর চলতে পারছেন না। বাধ্য হয়েই রাস্তায় নেমেছেন যদি কেউ কাজে নেয়। কিন্তু কোথাও কাজ নেই। তিনি জানালেন, জুরাইনের বস্তিতে তারা প্রায় দুইশ’ পরিবার থাকেন। সকলেরই প্রায় অভিন্ন দশা। জানতে চাইলে সিপিডি গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ইনকিলাবকে বলেন, সরকার প্রাথমিকভাবে নিম্নআয়ের মানুষের ৬ মাসের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম ও ওএমএস’র মাধ্যমে ১০ টাকায় চাল ও ন্যায্য মূল্যে অন্যান্য দ্রব্যাদি বিক্রি করছে। তবে এটা যথেষ্ট নয়। সরকার অবশ্যই করোনার বর্তমান প্রেক্ষাপট মূল্যায়ণ করবে। একই সঙ্গে প্রয়োজনে বাজেটের আগে এবং বাজেটে পৃথকভাবে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে।

সারাবিশ্ব করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। করোনাভাইরাসের ধাক্কা থেকে দেশের কর্মহীন শ্রমিকদের বাঁচাতে পাকিস্তান সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছে। সাংবাদিক সম্মেলনে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ইমরান জানান, দেশের গরিবদের বাঁচাতে ২০ হাজার কোটি পাকিস্তানি রুপি বরাদ্দ করা হয়েছে। বরাদ্দের মধ্যে ১৫ হাজার কোটি রুপি সরাসরি গরিবদের জন্য দেয়া হয়। যারা ‘দিন আনে দিন খান’ এমন মানুষদের মাসে ৩ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। সে দেশের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা নিম্নআয়ের শ্রমজীবী মানুষের খাদ্য সহায়তা দিচ্ছেন। অথচ বাংলাদেশে বড় বড় ব্যবসায়ীরা এখনো বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না। দু’একটি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল স্থাপনের ঘোষণা দিলেও সাধারণ মানুষ মনে করছে এর পিছনে অন্য কোনো মতলব রয়েছে। জানতে চাইলে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, করোনাভাইরাসের কাছে বিশ্ব ধীর ধীরে পরাস্ত হচ্ছে। মানুষের যেন আসলে কিছুই করার নেই। কত চেষ্টা জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে, অথচ লাশের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। রোগের কারণে মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়ছে ঠিক, কিন্তু সামাজিক এবং মানবিকবোধ জাগ্রত করার সুযোগও এসেছে। মানুষ মানুষকে ভালোবাসার সুযোগ পেয়েছে। মানুষ হিসেবে মানুষের যে দায়, তা উপলব্ধি করার সময় এসেছে। অথচ এমন সময়েও মানুষকে স্বার্থপর হতে দেখছি। হাসপাতাল করতে না দেয়া, লাশ দাফনে বাধার মতো ঘটনা মানব ইতিহাসে অসভ্যতা।

করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে সরকার ঘোষিত ছুটির মধ্যে শ্রমজীবী মানুষের তালিকা করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের খাদ্য সহায়তা দিতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। গত রোববার এই নির্দেশনা দেয়া হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. শাহ কামাল স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, কর্মজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে খাদ্য সমস্যায় আছেন প্রধানমন্ত্রী সেসব কর্মহীন লোক (ভিক্ষুক, ভবঘুরে, দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, পরিবহন শ্রমিক, রেস্টুরেন্ট শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, চায়ের দোকানদার) যারা দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে সংসার চালায় তাদের তালিকা প্রস্তুত করে খাদ্য সহায়তা দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সাধারণ মানুষ এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা পাননি।

জানতে চাইলে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ইনকিলাবকে বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এখন দরকার লঙ্গরখানা তৈরি করা। সরকারি সহায়তায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে এর বাস্তবায়নে দায়িত্ব দিতে হবে। বর্তমান করোনার প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে শহরের বস্তি এলাকার মানুষ। তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ভিজিডি ও ভিজিএফসহ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে। ৫ হাজার বা ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে কিছুই হবে না। প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য সরকারকে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।

ভারতে ২৪ মার্চ ২১ দিনের লকডাউন করা হয়। চার ঘণ্টারও কম সময়ের নোটিশ দিয়ে এই লকডাউন জারি করায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। ইতোমধ্যেই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ২ হাজার ২০০ কোটি ডলারের অর্থ সহায়তা তহবিল ঘোষণা করা হয়েছে। প্রায় অর্ধশত কোটি দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিনা মূল্য খাবার ও অর্থ সহায়তার ঘোষণা দেয়া হয়। ভারতের পশ্চিম বঙ্গে রাজ্যের ৭ কোটি ৯০ লাখ মানুষ রেশনে প্রতি মাসে ২ টাকা কেজি দরে চাল পেতেন; এখন সেটি বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তান, ভারতের মতো বাংলাদেশে শ্রমজীবীরা যাতে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা পান সে জন্য মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তবে কাজ না থাকায় ঘরবন্দি নিম্নবৃত্তদের এখনোই সহায়তা করা আবশ্যক। কারণ ক্ষুধার্থ মানুষকে বেশিদিন ঘরে আটকে রাখা সম্ভব নয়।

https://www.dailyinqilab.com/article/279539/