৩১ মার্চ ২০২০, মঙ্গলবার, ১২:১০

বৃত্তের বাইরে

আপাতত মানবিকতা স্থগিত!

আশপাশে চেনাজানা অনেকে ইদানীং কিছু বিষয়ে খুব বেশি সচেতন হয়ে উঠেছেন। যেন তারা অতিসচেতন হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তারা সব কথায় কান দিতে নারাজ। তাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে একটিই ভাবনা, সচেতন না হলে বিপদে পড়তে হবে। বিশেষ করে করোনার মাহামারীকালে যেখানে সচেতনতাই মুখ্য। ক্ষেত্রবিশেষে অতিসচেতন না হলে প্রাণ নিয়ে সংশয়ে পড়ার উপক্রম হবে। এই বিবেচনায় তারা অতিসচেতনতাকেই অতি ছোঁয়চে করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে নিয়েছেন! সে কথা মেনে সচেতনতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে উঠেপড়ে লেগেছেন। কেউ কেউ এমনও আচরণ করছেন যেমনটা মানুষ করে হিতাহিত জ্ঞান হারালে। ফলে সামাজিক জীবনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা মানবিকতা আপাতত স্থগিত করেছেন। তাদের ভাবখানা এই, মানবতা আপাতত মূর্ছা গেলেও এ নিয়ে দু’দণ্ড ভাবার অবকাশ কই। তবে কেউ কেউ এসব দেখে মৃদুস্বরে বলতে চাইছেন, চিরচেনা সমাজে মানবিকতার এ কী হাল! মানবিক গুণের এ কী শ্রী? তাদের জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, বাংলা ভাষায় এমনিতেই তো আর প্রচলন হয়নিÑ ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’। কিংবা ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ এমন সব কথা। সমাজে প্রচলিত এমন কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে কেউ যদি ছোঁয়াচে করোনা মোকাবেলায় অতিসচেতন হয়ে ওঠেন, তাদের দোষ দেয়া যায় কি? এমন আপ্তবাক্য কারো আরাধ্য হয়ে উঠতেই পারে! এত কিছুর পড়েও কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ না করে উপায় নেই। এতে পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে আমাদের কাজে লাগতে পারে।

ঘটনাস্থল বগুড়ার শিবগঞ্জ। ২৭ মার্চ। রাতভর জ্বর, সর্দি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হওয়ায় স্বামীকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে স্ত্রী সহযোগিতা চান পাড়া-প্রতিবেশীর। কাতর মিনতিতে কোনো কাজ হয়নি। এরপর সরকারি বিভিন্ন সংস্থার হটলাইনে আকুতি জানিয়েও সাড়া পাননি ওই নারী। করোনা-আতঙ্কে কেউ সহযোগিতায় এগিয়ে আসেননি। শেষমেশ মৃত্যুকেই বরণ করতে হয় তাকে। এখানেই শেষ নয়, তার দাফনেও বাধা দেন এলাকাবাসী। অবশেষে দাফন সম্পন্ন হয় বটে; সে জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে পোহাতে হয় ঝক্কিঝামেলা। লোকালয় থেকে বেশ দূরে এক পীরের মাজারের পাশে দাফনের প্রস্তুতি নেয়া হয়। কবর খুঁড়তে গেলে স্থানীয় বেশকিছু লোক বাধা দেয়। এই কাজে রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে বৃহত্তর স্বার্থে সবাই একাকার হয়ে যায়! তবে এলাকাবাসীর বাধা উপেক্ষা করে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে গত শনিবার রাত ৮টায় তার দাফন হয়। এ ঘটনায় বগুড়ার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক বেশ মর্মপীড়ায় ভোগেন। তার মতে, ‘হাসপাতালের হটলাইনে ফোন করা নারীর বর্ণনা শুনে মনে হলো, মানবতার নিক্তিতে আমরা হেরে গেছি।’ তার এই কথায় অনেকে অবশ্য অট্টহাসি দিয়ে বলতে পারেন, বেটা একটা আস্ত আহাম্মক। না হলে এই মহাবিপদে মানবতার ফেরিও করে কেউ।

কিশোরগঞ্জের একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক অ্যাম্বুলেন্সচালক আক্রান্ত হন সর্দি-জ্বরে। কর্তৃপক্ষ তাকে তিন দিনের ছুটি দেয়। তিনি চলে যান জেলার তাড়াইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। জ্বর-সর্দি করোনার উপসর্গ হওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোয়ারেন্টিনে রাখে। এ খবর জানজানি হলে করোনা হয়েছে সন্দেহে এলাকাবাসী তাকে হাসপাতাল ছেড়ে দিতে বলে। একপর্যায়ে পিটিয়ে এলাকাছাড়া করার হুমকিও দেয়। চালকের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা। প্রতিকার পেতে বিষয়টি পুলিশ প্রশাসনের নজরে আনা হয়। কিন্তু কিছুতেই স্থানীয়দের চাপ সামলাতে পারছিল না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। জীবনের ঝুঁকি টের পেয়ে শেষে জীবন রক্ষায় গত শুক্রবার ভোরে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে বাঁচে চালকসহ তার পরিবার। চালকের বক্তব্য বড়ই মর্মস্পর্শী, ‘মরার আগেই মরে গেলাম। মানুষের ঘৃণা আর অমানবিকতা দেখে আর বাঁচতে ইচ্ছা করছে না।’

ঢাকা থেকে রংপুরে পরিবারের কাছে ফিরছিলেন এক শ্রমজীবী। গত শনিবার রাতে পণ্যবাহী ট্রাকে রওনা দেন তিনি। পথে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট ও কাশি। করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে গত রোববার ভোররাতে তাকে ট্রাক থেকে ফেলে যাওয়া হয় বগুড়ার শিবগঞ্জের মহাস্থান বাসস্ট্যান্ডে। সেখানে অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেও কেউ এগিয়ে আসেননি। পরে ঠাঁই হয় হাসপাতালে। অথচ শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক বলেছেন, প্রাথমিক উপসর্গ দেখে মনে হয়েছে, তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নন। আগে থেকেই তার অ্যাজমা ও বক্ষব্যাধির সমস্যা ছিল। প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

মার্ক ফিনল্যান্ডের নাগরিক। মাস দুয়েক আগে বাংলাদেশে এসেছেন। দেড় মাস ধরে সিলেট নগরের হাওয়াপাড়া এলাকার একটি আবাসিক হোটেলে অবস্থান করছেন। অসুস্থ বোধ করায় শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টায় সিলেট নগরের হাওয়াপাড়া এলাকা থেকে চৌহাট্টার দিকে যাচ্ছিলেন হাসপাতালের উদ্দেশে। পথে মিরবক্সটুলা সড়কের পাশে একটি বন্ধ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সামনে গিয়ে পড়ে যান। করোনা আতঙ্কে কোনো পথচারী তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেননি। তবে অনেকে মুঠোফোন দিয়ে ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে ভোলেননি। শুধু পথচারীরা নন, ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশের কোনো সদস্যও ওই ব্যক্তিকে উদ্ধারে হাত বাড়াননি। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বিষয়টি সিভিল সার্জনকে জানায়। পরে সন্ধ্যায় সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থল থেকে ফিনল্যান্ডের ওই নাগরিককে উদ্ধার করে।

এ দিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ৩০১ শয্যার একটি হাসপাতাল তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়ে আকিজ গ্রুপ রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায় নির্মাণকাজ করতে গেলে শনিবার শ’দুয়েক মানুষ তাতে বাধা দেয়। ফলে সাময়িক বন্ধ থাকে হাসপাতালের নির্মাণকাজ। অভিযোগ ওঠে, ডিএনসিসির স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে বাধা দেয়া হয়। হাসপাতাল করার বিষয়ে ওই কাউন্সিলরের বক্তব্য, ‘এটা যেহেতু মহল্লায় হচ্ছে, তাই এখানে করোনারভাইরাসে আক্রান্তদের হাসপাতাল হওয়া ঠিক হবে না। আমি এটার পক্ষে না।’

সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যমের সংবেদনহীন শিরোনামগুলো দেখে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়, সামাজিক বন্ধনের অন্তর্গত সুমধুর রসায়নকে প্রায়ই অস্বীকার করছি আমরা। এ রকম কয়েকটি অসঙ্গত শিরোনাম-

স্বামী ইতালি হতে ফিরেছে জেনে স্ত্রীর পলায়ন, করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে প্রবাসীকে গণপিটুনি, প্রবাসী জেনে রোগীকে রেখে ডাক্তারের পলায়ন, প্রবাসীদের বাজারে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা বাজার কমিটির। এসব সংবাদ পড়ে বলা যায়, আমরা সহজ অনুধাবন, কাণ্ডজ্ঞান এবং বিবেচনাবোধও হারিয়ে ফেলছি। সমাজ নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের শারীরিক আক্রমণের অনেকগুলো ঘটনা যে ঘটেছে, সেসব সংবাদ আমাদের জানা হয়ে গেছে। মহামারীর যেকোনো কালের মতো বর্তমান সময়টিও সামাজিক দুর্যোগের কাল। কলঙ্কবোধ এ সময়ের অন্যতম বড় সামাজিক সমস্যা। একটি সময় ছিল যখন মানুষ আশপাশে এইডস রোগী আছে শুনলে পালাত। স্বামীকে ছেড়ে পালাত স্ত্রী। সন্তানরা ফেলে যেত বাবা-মাকে। কোনো গ্রামে এইডস রোগী একজন শনাক্ত হলে গ্রামবাসীর অনেকে ভিটেমাটি বিক্রি করে অন্য জায়গায় চলে যেতেন। এখন আমরা জানি, এইডস কথায় কথায় ছড়ায় না এবং এটি নিরাময়যোগ্য রোগ। আমরা অনেকে কুষ্ঠরোগীদের দুঃসহ সামাজিক যন্ত্রণার কথা প্রায় বিস্মৃত হতে বসেছি।

ইংরেজি ‘স্টিগমা’র বাংলা ‘কলঙ্কভীতি’। রোগীর প্রতি একধরনের কলঙ্কজাত ঘৃণা আরোপ করাই স্টিগমা। ঘৃণার পেছনে থাকে সংক্রমণের ভয়। তারও আড়ালে থাকে অজ্ঞতা, তথ্যের অভাব, গুজব, সংবেদনহীন জনশ্রুতি ইত্যাদি।

করোনা বিষয়ে আমাদের সচেতনতার জায়গাটি এখনো যথেষ্ট নয়। ফলে কারো জীবনের দুর্বল মুহূর্তে তাদের সাথে আমরা এমন অমানবিক আচরণ করতে লজ্জাবোধ করি না বা কুণ্ঠিত হই না। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, ইহজাগতিক জীবনে কিছুই স্থায়ী নয়। যত দুঃসময় আসুক, তা ক্ষণিকের। করোনা চলে গেলে অর্থনৈতিক মন্দা আসতে পারে; সেটিও কিন্তু চিরস্থায়ী নয়। সেখান থেকেও কিন্তু আমাদের বেরিয়ে আসার সুযোগ আছে। তাই করোনা পরিস্থিতি আমরা কোনোভাবে এড়িয়ে যেতে পারব না। আমরা যতই আতঙ্কগ্রস্ত হই, উদ্বিগ্ন হই, তাতে কোনো লাভ নেই।

camirhamza@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/492254