৩১ মার্চ ২০২০, মঙ্গলবার, ১২:০৪

করোনার প্রভাব

পানির দামে দুধ

প্রান্তিক খামারিরা বিপর্যস্ত

পাঁচ সদস্যের সংসার বাদশা মিয়ার। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার পোতাজিয়া ইউনিয়নের রেশমবাড়ি গ্রামের এই পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস গরুর ছোট্ট একটি খামার। কখনও অভাবে পড়তে হয়নি তাদের। করোনার প্রভাবে বাদশার সংসারে বিপর্যয় নেমে এসেছে। গাভি থেকে দু'বেলা দুধ পেলেও ক্রেতা নেই। এলাকায় ঘুরে ঘুরে মাত্র ১০ থেকে ১৫ টাকা লিটার হাঁকিয়েও বেচতে পারছেন না দুধ। এতে সংসারের খরচ দূরে থাক, খামারের খরচ মেটাতেই পড়তে হচ্ছে ঋণের ফাঁদে।

করোনার প্রভাবে শুধু বাদশা মিয়া কিংবা শাহজাদপুর নয়, সারাদেশের দুগ্ধ খামারে নেমে এসেছে বিপর্যয়। বড় খামারিরা বিকল্প ব্যবস্থায় সামান্য হলেও দুধ প্রক্রিয়াজাত করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তবে প্রান্তিক খামারিরা করোনার ধাক্কায় বিপর্যস্ত। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ গাভি বিক্রি করে দিচ্ছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দিনে অন্তত ৯০ কোটি টাকার দুধ অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে বলে জানাল বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ)। চলমান অবস্থা এক মাস থাকলে দুগ্ধ খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে আড়াই হাজার কোটি টাকা।

বাদশার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। গরু বিক্রি করে হয়তো পথে বসতে হবে। গতকাল সমকালকে ফোনে বলেন, 'নিজেরাই খাইতে পারছি না ঠিকমতো, গরুর খাবার কী করে দিব।' তিনি জানান, খামারে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়। গত এক সপ্তাহে মাত্র ছয় হাজার টাকার দুধ বিক্রি করেছেন। গোখাদ্য জোগাড় করতে বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়েছেন। সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটাবেন, সে চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না। অন্য সময় প্রতিলিটার দুধ বিক্রি করেন ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। এখন সেধে সেধে পানির দরেও তা বেচতে পারছেন না।

করোনাভাইরাস সংক্রমণে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে গত বৃহস্পতিবার থেকে দেশ কার্যত লকডাউন। গণপরিবহন ও দোকানপাট বন্ধ। বন্ধ রয়েছে দুধের অন্যতম গন্তব্য মিষ্টির দোকানগুলোও। মিষ্টিসহ দুগ্ধজাত বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ রয়েছে। ফলে গত বৃহস্পতিবার থেকে দুধের সরবরাহ কমতে থাকে।

সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের প্রত্যন্ত কয়েকটি গ্রামে খবর নিয়ে জানা গেছে, অবিক্রীত দুধ থেকে ঘি-মাখন তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছেন অনেক খামারি। যাতে পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারেন। তবে সংরক্ষণ অপ্রতুলতায় ওই প্রচেষ্টায়ও খুব বেশি অগ্রসর হতে পারছেন না অনেকে। বাধ্য হয়ে দুধ বিক্রি করা হচ্ছে পানির দরে। এ অবস্থায় প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক খামারি গরু বিক্রি করে দিয়েছেন বলে খবর আসছে। অনেকে বিক্রি করে দেওয়ার চিন্তা করছেন।

বিডিএফএর সভাপতি ইমরান হোসেন সমকালকে বলেন, দেশে দুধের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৯৯ লাখ টন। এই খাতের গতি খুবই ভালো ছিল। করোনার প্রভাবে সবকিছু তছনছ হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে উৎপাদনের অন্তত ৯৫ শতাংশ দুধ বিক্রির জায়গা বন্ধ রয়েছে। সামান্য দুধ পানির দরে বিক্রি করা গেলেও বড় অংশই অবিক্রীত। অনেকে ক্রিম আলাদা করে রাখছেন। কেউ কেউ ঘি বানানো শুরু করেছেন। এতে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যেতে পারে। তবে প্রান্তিক খামারিদের ওই সুযোগ নেই। তারা অনেকেই ইতোমধ্যে পথে বসেছেন।

তিনি আরও বলেন, 'আমরা খবর পেয়েছি, বিভিন্ন এলাকায় প্রান্তিক খামারিরা গোখাদ্য কিনতে না পেরে গাভি বিক্রি করে দিচ্ছেন। এ ছাড়া তাদের আয়ের আর কোনো পথ নেই। তারা দীর্ঘমেয়াদি একটি সংকটের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন।'

গত পাঁচ বছরে দুধের উৎপাদন তিন গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা জানিয়ে বিডিএফএ সভাপতি বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে দুধের বার্ষিক উৎপাদন দেড় কোটি টনে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে করোনার ধাক্কা সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। চলমান বিপর্যয় সামাল দিয়ে কতগুলো খামার টিকে থাকতে পারে, সেটিই এখন ভাবনার বিষয়। খামারিদের জন্য সরকারের প্রণোদনা প্রত্যাশা করেন তিনি।

জানা গেছে, দেশে প্রায় সাড়ে তিন লাখ দুগ্ধ খামার রয়েছে। এর ওপর নির্ভরশীল প্রায় সোয়া কোটি মানুষের জীবিকা। বাংলাদেশে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলো দেশের মোট উৎপাদিত দুধের মাত্র ৫ শতাংশ প্রতিদিন সংগ্রহ করে। বাকি দুধ খামারিরা মিষ্টির দোকান ও বাসাবাড়িতে বিক্রি করেন। এখন উৎপাদিত দুধের প্রায় ৯৫ শতাংশ গন্তব্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক খামার বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামার) ডা. মোহাম্মদ আলী সমকালকে বলেন, বেসরকারি প্লান্টগুলো এগিয়ে না এলে প্রান্তিক খামারিরা সর্বস্বান্ত হয়ে যেতে পারে। কারণ, তাদের মজুদ করার সক্ষমতা নেই। এ মুহূর্তে ক্রেতা নেই। দামও পাচ্ছেন না। সামনে রমজান মাস, এ উপলক্ষে অনেকের নানা পরিকল্পনা ছিল। করোনা তাদের সেই পরিকল্পনা ধ্বংস করে দিয়েছে।

দুধের জন্য অনেক নামডাক সিরাজগঞ্জের। ওই অঞ্চলের খামারিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সেখানকার খামারিদের অবস্থা খুবই নাজুক। এ জেলায় প্রতিদিন ২০ লাখ ২৭ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে শাহজাদপুর উপজেলায় উৎপাদন হয় প্রায় সাড়ে চার লাখ লিটার। দুধ উৎপাদনের দিক থেকে শাহজাদপুরের একটি খ্যাতিও রয়েছে দেশব্যাপী।

এই উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, এ অঞ্চলে উৎপাদিত দুধের বড় অংশ কিনে নেয় মিল্ক্ক-ভিটা কোম্পানি। তারা বর্তমানে দুধের সংগ্রহ অর্ধেকে নামিয়েছে। ফলে বাকি দুধ নিয়ে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা বিপাকে পড়েছেন। তিনি জানান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে প্রান্তিক খামারিদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে যেন সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়।

তবে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার করেরহাটে অবস্থিত হিলস ডেল মাল্টি ফার্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈন উদ্দিন সমকালকে জানান, কোম্পানির নিজস্ব গাড়ি দিয়ে ভোক্তার বাড়িতে দুধ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। তবে চাহিদা অনেক কমে গেছে। আরও কমতে পারে বলে তার আশঙ্কা।

একই উপজেলায় অবস্থিত নাহার এগ্রোর খামারে নেমে এসেছে বিপর্যয়। এ প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় কর্মকর্তা আলী হোসাইন সমকালকে জানান, এখানে দিনে প্রায় দেড় হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়। মিষ্টির ও অন্যান্য দোকান বন্ধ থাকায় বিক্রি নেমেছে এক-তৃতীয়াংশে। হোম ডেলিভারির মাধ্যমে অনেক জোর তদবির করে দুই লিটারের সঙ্গে এক লিটার ফ্রি দিয়ে বেচতে হচ্ছে। খামারেই নষ্ট হচ্ছে অবিক্রীত দুধ।

https://samakal.com/bangladesh/article/200317178